বলাৎকার/ধর্ষণের শিকার শিশুদের পক্ষে বলার কেউ নেই?

Uncategorized

বলাৎকার/ধর্ষণের শিকার শিশুদের পক্ষে বলার কেউ নেই?

গতকাল নিউজিল্যান্ড কেঁপে উঠেছে এক গবেষণার ফল দেখে। নিউজিল্যান্ডে সরকারি-ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে আড়াই লক্ষের বেশি মানুষ নানাভাবে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ১৯৫০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। গত কয়েক দশকে নিউজিল্যান্ডের বিশ্বাস-ভিত্তিক এবং রাষ্ট্রীয় কেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলিতে বহু শিশু, তরুণ এবং দুর্বল প্রাপ্তবয়স্কদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের মুখে পড়া বেশির ভাগেরই বয়স পাঁচ থেকে সতের। তবে নির্যাতনের মাত্রা বেশি হয় পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সীদের উপর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বাসভিত্তিক বা ধর্মীয় গৃহে শিশু এবং যুবক-যুবতীদের নির্যাতনের আশঙ্কা থাকে ২১ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত। এ ধরনের নির্যাতন এখনও অব্যাহত রয়েছে বলছে রয়্যাল কমিশন।

ক্যাথলিক চার্চে যাজকদের হাতে শিশুদের যৌন নিপীড়নের বিপুল ঘটনা ঘটতে দেখেছি খুদ ইউরোপেই। উত্তর আয়ারল্যান্ডের টিভিতে ১৯৯৪ সালে একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছিল যাতে – ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হবার কাহিনী ফাঁস করে দেয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানের পর আরো অনেকেই তাদের একই রকম অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরে এরই সূত্র ধরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে শিশুদের যৌন নিপীড়নের বহু কাহিনী প্রকাশ পায়। তৎকালীন পোপ বেনেডিক্টকেও এজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। সাফার লিটল চিল্ড্রেন নামের ওই অনুষ্ঠানটিতে ছিল – একজন ক্যাথলিক যাজকের গল্প যিনি একজন শিশুকামী – যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার শিশুরা বিষয়টি গোপন রেখেছে বছরের পর বছর, অনেকে কখনোই প্রকাশ করেনি। ইউরোপ, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশেও অনেকেই যাজকদের যৌন নিপীড়নের শিকার হবার ঘটনা ফাঁস করে দিতে লাগলেন। ক্যাথলিক চার্চ একটা সংকটে পড়ে গেল। সব যাজকগণ শিশু বলাৎকার/ধর্ষণ না করলেও তারা সবাই অবপাধী কারণ তারাও এসব গোপন রাখতে সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশে এ বছরও এজটি গীর্জায় এক নারী শিশু এক ফাদারের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষিতা হয় যে সকল দেশে তার শীর্ষের একটি ভারত। ২০১৭ সালে ভারতে ২৪ লক্ষের বেশি শিশু ধর্ষিতা হয়। ১৭ জানুয়ারি ভারতের জম্মু কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলার একটি মন্দিরে আসিফা নামের এক শিশুকে এক সপ্তাহ ধরে গণধর্ষণ করা হয়৷ এরপর না খাইয়ে মন্দিরে আটকে রাখা হয়৷ হত্যা করার আগে আসিফাকে মন্দিরের মধ্যেই আবারো ধর্ষণ করা হয়৷ কর্ণাটকে কিছুদিন আগে এক নারী মন্দিরে পূজা দিতে গিয়ে সংঘবন্ধ পুরোহিতদের হাতে ধর্ষিতা হয়। চুঁচুড়ায় শিবমন্দিরে প্রসাদ আনতে যাওয়া ৭ বছরের শিশুকন্যাকে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে ধর্ষণ করে পুরোহিত। এমন হাজারো উদাহরণ টানা যাবে। তান্ত্রিক সাধনায় সিদ্ধহস্ত হরিয়ানার‘বাবা’ অমরপুরির বিরুদ্ধে শতাধিক নারী ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ফতেহাবাদ জেলার তোহানার আশ্রম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বাবার ডেরা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১২০ জন নারীকে ধর্ষণ করার ভিডিও ফুটেজ। গুরুমিত রাম রহিম সিং এর আশ্রমি হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হতেন। উত্তর প্রদেশের বস্তি জেলার সন্তু কুটির আশ্রমে স্বঘোষিত আরেক ধর্মগুরু স্বামী সচ্চিদানন্দের বিরুদ্ধেও অসংখ্য নারী-শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। আরেক স্বঘোষিত ‘গডম্যান’ বা বাবার সন্ধান মেলে দিল্লি রোহিণী এলাকার একটি আশ্রম ও আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই আশ্রমের প্রধান আরেক স্বঘোষিত বাবা বীরেন্দ্র দেব দীক্ষিত। তিনিও তাঁর আশ্রমের কিশোরীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতেন। দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে ওই আশ্রম থেকে উদ্ধার করা হয় ৪০ কিশোরীকে। ভারতে ভণ্ডবাবাদের আশ্রমে এভাবেই যৌন নির্যাতনের শিকার হন হাজার হাজার শিশু, কিশোরীসহ নারীরা।

বাংলাদেশেও ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। এই সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে- মোট ধর্ষণের শিকার ১৩ হাজার ৬৩৮ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২ হাজার ৫২৯ জন এবং ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ৬ হাজার ৯২৭।  ধর্ষণ পরবর্তী খুন ১ হাজার ৪৬৭ এবং ধর্ষণ পরবর্তী আত্মহত্যা ১৫৪ জনের। ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৭০৩ জন। বাংলাদেশে ছেলে শিশু ধর্ষণের প্রচুর সংবাদই পত্রিকায় আসে। এর মধ্যে মাদ্রাসায় শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের দ্বারা বলাৎকারের সংখ্যাই সিংহভাগ। একের পর এক শিশুদের বলাৎকার করা হয়। এ বছর একজন শিক্ষক দাবি করেন তিনি বলাৎকার করার সময় খেয়াল রাখেন যাতে মাদ্রাসার শিশু-ছাত্ররা বেশি ব্যথা না পায়। সে মানবিক বলাৎকারক হিসেবে খ্যাতি পায়। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ১২ শিশুছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ আল আমিন তার অপরাধের কথা স্বীকার করে দাবি করেছিলেন,  “শয়তান ভর করায়” ধর্ষণ করেছেন তিনি। এ বছরও ফতুল্লায় এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে (১০) ধর্ষণের অভিযোগে কাউছার আহম্মেদ (২৮) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুধু ফতুল্লা নয় সারাদেশেই এমনটা ঘটছে। ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চ বা নিউজিল্যান্ডের ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে শিশু ধর্ষণের চেয়ে বাংলাদেশে ছেলে শিশুরা এবং মেয়ে শিশুরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভিতরে আরো বেশি মাত্রাতেই ধর্ষিতা/বলাৎকারের শিকার হয়। এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় নিউজ হলে সামাজিক মিডিয়াতে সামান্য হইচই হয় এবং সবমহল মিলেই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায়। শয়তানের উপর দোষ চাপিয়ে তারা পার পেয়ে যায়। প্রকাশিত সংবাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি শিশুরা ধর্ষন/বলাৎকারের শিকার হয়। আমাদেরও ভাবতে হবে- কেন শিশুরা সরকারি শিশু সদনে থাকতে চায় না? যদি বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশু বলাৎকার/ধর্ষণ নিয়ে অমন একটি রিপোর্ট করা যেতো এবং তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করা যেতো তবে হয়তো হইচই হতো এবং সরকার একটি পদক্ষেপ নিতো শিশুদের রক্ষা করার জন্য।

বলাৎকারের শিকার শিশুগুলো সারাজীবনই মনোবৈকল্যে ভূগে এবং একসময় এমন বিকৃত যৌনাচারে নিজেরাও জড়িয়ে পড়ে। মেয়ে শিশুদের জীবনটা আরো বেশি কষ্টকর হয়ে উঠে। সমাজ ওই শিশু মেয়েদের দিকেই আঙুল তুলে তাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বলাৎকার/ধর্ষণের শিকার শিশুদের পক্ষে বলার কেউ নেই?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *