বাংলাদেশে এক বিলুপ্তপ্রায় মাছ ধরার প্রকরণ — ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার ।

Uncategorized

বাংলাদেশে এক বিলুপ্তপ্রায় মাছ ধরার প্রকরণ — ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার । হারিয়ে যেতে বসা এই ইতিহাসপ্রাচীন কৌশল এখন শুধু বেঁচে আছে বাংলাদেশের খুলনা আর নড়াইলের গোটা দশ-বারো গ্রামে । একমাত্র মালো জেলেরাই এতে পারদর্শী ।

কৈবর্ত, তিয়র এবং মালো — এই তিন জনগোষ্ঠীকে ভাটি বাংলার আদি বাসিন্দা হিসেবে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করে নিয়েছেন । এরা সবাই মৎসজীবী । মালোরাই এদের মধ্যে সেরা নৌয়ায়িক । যুদ্ধবাজ বীরের জাত এরা , যে হাতে কৃষ্ণকীর্তনের খোল বাজায় , সেই হাতেই সড়কি , লাঠি তুলে শত্রুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় । আদি বাঙালি মারপিটের সময় যে মালকোঁচা মেরে ধুতি এঁটে বাঁধত , তা এসেছে মালো- দের নাম থেকেই ।

চিত্রা নড়াইল জেলার প্রধান নদী । প্রাক-বর্ষায় এবং শীতকালে মালোরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে সুন্দরবনের নদীতে আর বাকি মাসগুলোয় এই নড়াইলের চিত্রা ও আশেপাশের নদীতে । ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার মানে এই তো নয় যে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিতে ঢোকা মাসমাইনের স্টাফের মত ভোঁদড়রা মান্থলি টার্গেট মাফিক মুখে করে মাছ ধরে এনে মাঝির পায়ের কাছে জড়ো করবে !! মালোদের এই অধীত বিদ্যে তাদের সাতপুরুষের অনুশীলনের ফসল যা প্রাচীনকালে প্রচলন ছিল দক্ষিণের করমন্ডল উপকূলে । কোন সুদূর অতীতে দাক্ষিণাত্যের মাটি ছেড়ে এই জনগোষ্ঠী চলে এসেছিল নিন্মগাঙ্গেয় বঙ্গদেশে তার খবর কে রাখে ?

মালোদের এক বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা । সুন্দরবনের দুবলার চরে রাসমেলা বাংলাদেশের খুব জমকালো উৎসব । বৈষ্ণব ঘরানার এই উৎসবে সুন্দরবনের সন্নিহিত গ্রাম গ্রামান্তর থেকে কৃষিজীবী , মৎসজীবী থেকে প্রান্তিক মানুষজন সহ অনেকেই এই একফালি দ্বীপটিতে জড়ো হলেও আসলে এ মেলায় আগে ছিল ভাটি বাংলার ঝালো – মালোদের আধিপত্য । ঝালো এসেছে জালো থেকে , মানে যারা জাল ফেলে তাদের বোঝাতে । এখন মালোরা তো আদিতেই মৎসজীবী , তাহলে তাদের নামের আগে ঝালো জুড়তে হল কেন ? কারণ গত দুশো-আড়াইশো বছরে মালোদের একটা বড় অংশ জালি থেকে হালিতে ( মানে কৃষিজীবী) রূপান্তরিত হয়েছে । জাউল্ল্যা বা জালো ( ঝালো) মানে তারাই যারা আদি পেশায় রয়ে গিয়েছে ।

আজকের দুবলার চরে রাসপূর্ণিমা এক আদ্যন্ত হিন্দু পার্বন । দেবদেবীর মূর্তি , বর্ণহিন্দু নৈষ্ঠিকতা , ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য  — সনাতন ধর্মের নিগড়ে বাঁধা এক উৎসব , কিছু লোকায়ত অভ্যাস সত্ত্বেও । কিন্তু মালোরা কি আদতে হিন্দু ? বল্লালসেনের প্রকরণের মাপকাঠি অনুসারে তো নয়ই এমনকি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ যে বঙ্গকৌমকে হীন জ্ঞানে ( বিতর্ক আছে ) ‘ বয়াংসী ’ বলে ব্রাত্য করে দিয়েছিল , মালোরা তো সেই কৌমেরই অংশ । বাগদি , কেওট , তিয়রদের মতো মালোরাও টোটেম উপাসক , যে টোটেম পূজাকে কিন্তু হিন্দুধর্ম অনুমোদন দিয়েছে । মালোদের টোটেম হল গঙ্গানদী । দুবলার চরের রাস পার্বণ আদিতে এই টোটেমেরই অর্চনা ।

একসময় বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম নিন্মবঙ্গের অন্ত্যজদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল । নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বৌদ্ধ বামাচারী ১২০০ নেড়া আর ১৩০০ নেড়িকে গৌরমন্ত্র দিয়ে জাতে তুলে দৃপ্ত ঘোষণা করেন —-

      নিত্যানন্দ স্বরূপ সে নাম যদি ধরো ।
      আচন্ডাল যদি আমি বৈষ্ণব না করোঁ । ।
      জাতিভেদ না করিমু চন্ডাল যবনে ।
      প্রেমভক্তি দিয়া সভে নাচামু কীর্তনে । ।

কার্তিক পূর্নিমার সারা রাত আধো জাগরনে আধো ঘুমে কাটিয়ে জলস্রোতের সীমানা ছুঁয়ে সার বেঁধে বসে নারীরা , তাদের প্রত্যেকের সামনে রাখা থাকে ডাব যার মধ্যে তাদের মনোকামনা পুরে রাখা আছে । সাগরের ঢেউ এসে তাদের কোলে মৃদু ঠেলা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যায় ডাবগুলোকে । এরপর প্রতিক্ষা । যদি ফিরতি ঢেউ আবার সে ডাব ফিরিয়ে দেয় , তবে তার মনোস্কামনা পূর্ণ হবে — নয়তো আবার অপেক্ষা পরের রাসপূর্ণিমা অবধি ।

এই নিরুচ্চার প্রতিক্ষা , ডাবের অনুষঙ্গ , গঙ্গার টোটেম , জল আর প্রান্তিক মানুষজনের এক প্রকৃতি পূজারি আদিম বঙ্গকৌমের যুগান্ত লালিত বিশ্বাস মনে পড়ায় যাদের নিত্যানন্দ-চৈতন্য ব্রাহ্মণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বৈষ্ণব করেছিলেন , টোটেমিক নৃ-গোষ্ঠীকেও নিয়ে এসে ফেলেছিলেন বেদ-ব্রাহ্মণের দ্বারে । তাই ‘ তিতাস একটি নদীর নাম ’ -এ প্রথম পরিচয়পর্বে মালো সাধু মালো কিশোরচাঁদকে প্রশ্ন করে — তারা কি কৃষ্ণমন্ত্রী , নাকি শিবমন্ত্রী ? নতুন শ্বশুর নাম জিজ্ঞাসা করলে কিশোর জবাব দেয় —– ‘ শ্রীযুক্ত কিশোরচাঁদ মূল্যব্রাক্ষ্মণ । পিতা শ্রীযুক্ত  রামকেশব মূল্যব্রাক্ষ্মণ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *