বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক
শিতাংশু গুহ, ৪ঠা জুলাই ২০২১, নিউইয়র্ক।। বাংলাদেশ থেকে স্কুল শিক্ষিকা একটি অবিবাহিতা হিন্দু মেয়ে ফোন করে ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’ সংশোধনী নিয়ে কথা বললেন। মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনলাম। তাঁর মতে এই আইন হিন্দুর মধ্যে গন্ডগোল লাগানোর নুতন ফন্দি। তিনি বেশকিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বোঝাতে চাইলেন যে, হিন্দুরা উঠে দাঁড়াতে চাইছে, তাই তাদের কোমড় ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে এই আইন। তিনি আরো বললেন, হিন্দু ভাই-বোনের চমৎকার সম্পর্ক নষ্ট করাও এর আর একটি লক্ষ্য। তাঁকে বললাম, আপনি কি বাবার সম্পত্তিতে অধিকার চাননা? উত্তর, অবশ্যই চাই, কিন্তু হিন্দু নারীরা তো অরক্ষিত, আগে সুরক্ষা দেন, তাঁরপর সম্পত্তি। একটু ব্যাখ্যা করুন? বললেন, হিন্দু নাবালিকা ধর্মান্তর মহামারী আকার ধারণ করেছে; হিন্দু সম্পত্তি জবর-দখলের মহোৎসব চলছে, হিন্দুর সম্পত্তি থাকলে তো কন্যাকে দেবে? তাই আগে সুরক্ষা দিন্।
‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’ সংশোধনী মূলত হিন্দু নারীর অধিকার নিয়ে কিছু সুপারিশ। তাই ক’জনা নারীর সাথে কথা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু নারীর মন্তব্য পড়েছি। সংশোধনীতে বেশ ক’টি বিষয় আছে, এরমধ্যে মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার দেয়ার বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। কন্যাকে সম্পত্তি দিতে এমনিতে যে কারো খুব একটা যে আপত্তি আছে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্যে ভাল কাজ করার কোন রেকর্ড কোন সরকারের নেই, তাই একটি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ভয় কাজ করছে। হিন্দু যাঁরা এর পেছনে তাঁদের অতীত রেকর্ড সুবিধার নয়? তাই প্রশ্ন জেগেছে, এই গোষ্ঠী হটাৎ হিন্দুদের জন্যে ‘মাঠে নেমে’ পড়লেন কেন? সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে, হিন্দু ভাই-বোনের চমৎকার সম্পর্কে ‘বিষ’ ঢালতে এবং হিন্দুদের দুই ভাগে বিভক্তি এ আইনের লক্ষ্য? আইনের বেশ কিছু ধারা যথেষ্ট কৌশলী বা সন্দেহজনক।
আমাকে একজন সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, ‘শত্রু-সম্পত্তি’ আইন স্বাধীন বাংলাদেশে বহাল থাকলে হিন্দুরা তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। এতে তাঁদের প্রায় ত্রিশ লক্ষ একর সম্পত্তি খোঁয়া গেছে এবং এটি বাতিল করতে ৪৭ বছর সময় লেগেছে। একইভাবে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন’ পাশ হলেও হিন্দুরা ভেবেছিলো তাদের কি? এখন দেখা যাচ্ছে, এই আইনটি ‘ব্লাসফেমি’’ হিসাবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং অসংখ্য হিন্দু যুবক-যুবতী এই আইনে ‘ইসলাম অবমাননার’ দায়ে বিনা বিচারে জেলে বন্দী রয়েছেন। তারমতে হিন্দু পারিবারিক আইন সংশোধনী শ্রুতিমধুর হলেও এটি যে, ‘সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবে’ না, এর গ্যারান্টি কোথায়? তিনি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন, এই আইন হিন্দুর বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। বললাম, ভারতে তো এই আইন আছে? তিনি জানালেন, ভারতে ৩% মুসলমান বেড়ে ১৪%, আর বাংলাদেশে ২০% হিন্দু কমে ১০%!!
এটি সত্য এবং কঠিন বাস্তবতা যে, সরকার বা যাঁরা ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’ সংশোধনের পক্ষে তাঁরা ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ সংশোধনের কথা চিন্তাও করতে পারেন না? তাহলে তাঁরা ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’-এ হাত দিচ্ছেন কোন অধিকারে? আইন কমিশনের ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’ সংশোধনী খসড়া আমি পড়েছি। বোঝা যায়, এর প্রনেতাদের ‘হিন্দু-আইন’ সম্পর্কে অজ্ঞতা আছে? ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’ কয়েক হাজার বছর পুরাতন, এর কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়তো আছে, কিন্তু এরপরও এটি ‘অতি-উত্তম’। হিন্দুর সংসার একটি পারফেক্ট গার্হস্থ্য জীবন। বিয়ে-বিচ্ছেদ প্রায় শূন্য। ধর্মীয় আচার-আচরণ প্রকৃতি-নির্ভর ও সংস্কৃতিতে ভরপুর। এসব পরিবর্তন করার অধিকার কি আপনার আছে? কেউ কেউ এই সংশোধনীকে ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’র ‘ইসলামীকরণ’ হিসাবে আখ্যা দিচ্ছেন। একজন স্মরণ করিয়ে দেন যে, মাত্র সেদিন সরকার ‘বাল্যবিবাহ’ আইন করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন?
তাহলে সমাধান কি? সমাধান হচ্ছে, সরকার হিন্দু বা মুসলিম পারিবারিক আইনে হাত না দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে সংসদে বিল এনে একসাথে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, বা ইত্যাকার সকল বিষয়ে আইন পাশ করতে পারেন। এরশাদ যেমন ১৯৮৮ সালে সংসদে মাত্র ১০মিনিটে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বিল পাশ করেছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিমিষে তা করতে পারেন। একে বলে ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ এবং তা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্যে প্রযোজ্য। উন্নত বিশ্বে তাই আছে। প্রশ্ন হলো, সরকার তা করবেন কিনা? না করলে ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’-এ হাত দেয়ার দরকার নাই! যারা ভাবছেন, হিন্দু ভাই তাঁর বোনকে সম্পত্তি দিতে আগ্রহী নন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, বোন কিছু সম্পত্তি নিলেও বৌ কিছু সম্পত্তি নিয়ে আসবে, তাই বিষয়টি সমান-সমান। সমস্যা অন্যত্র। আগেই বলেছি, সন্দেহ-অবিশ্বাস-ভয়। আপনাদের কি বিশ্বাস করা যায় বা বিশ্বাস করার মত কোন কারণ কি আছে? অতীত রেকর্ড কি বলে?# guhasb@gmail.com;