(আমরা সম্ভবত শেষ প্রজন্ম, যাদের পিতা-মাতার সাথে ছবি খুব একটা নেই।আমাদের সময়ে ছবির এলবাম ছিল বড়লোকেদের শখের মতোই।যার এলবাম যত বড়, যার ক্যামেরা যত ভালো, তিনি তত ধনী।আমরা ধনী না হলেও আমাদের রিল এর ছবি নেহাৎ কম ছিল না 😎একখানা ছবি পোস্টের সাথে সংযুক্ত করলাম)
আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার।যৌথ পরিবারের দায় দায়িত্ব সামলে, আমাদের বাবারা হয়ে যেতেন নিম্ন মধ্যবিত্ত।যদিও স্বীকৃতি পেতেন না কোনখানেই।বৃহৎ পরিবারে উনাদের অবদান আর খুঁজে পাওয়া যায় না আতস কাঁচ দিয়ে।মায়েরা সারাজীবন কৃচ্ছসাধন এর কপাল নিয়ে আফসোস করে যান।আমরা ও সুযোগ পেলে আমাদের প্রয়োজন এর বাইরের অভাব পূর্ণ না হবার ফিরিস্তি দিয়ে বাবাদের কোণঠাসা করি কখনো বা।বাবারা শোনেন, কখনো উত্তর দেন, কখনো এড়িয়ে যান।
আমাদের বিলাসের জীবন না থাকলেও অভাব ও খুব একটা ছিল না, কারণ আমাদের বাবার এক কাপড়ে চলে যেতো বছর দশেক, এক জুতোয় চলে যেতো বছর পাঁচেক।মায়ের সাথে ছুটির দুপুরে বালিশের কভার, লেপের কভার এর মাপজোক করে সেলাই করে ফেলতেন বলে এদিকেও বেঁচে যেতো অনেক খরচ।অফিস থেকে ফেরার পথে হেঁটে আসতেন বেশ খানিকটা পথ।তাতে হয়ে যেতো আমাদের টিফিন খরচ।আমাদের অভাব ছিল না। ছিল না,বাবাদের প্রবল মিতব্যয়ের কারণে।সারাজীবন সংগ্রাম করে, আমাদের এতোদূর আনার পরে, বাজার করে ফেরার পথে এখনো মেরুদণ্ডের সমস্যা সত্ত্বেও বিশাল ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসেন বাবা। রাগ করি এখন। কিন্তু এই কৃচ্ছতাসাধনের অভ্যেস ছাড়াতে পারিনা।এতোটাও ভালো নয়।বাবাদের তাই শাসন করতে হয়।এই সর্বংবহা ধ্যান ধারণা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করি।বাবা মানেই কেবল ত্যাগ নয়,কেবল নিজেকে হারিয়ে সন্তান কে দেওয়া নয়……এটুকু আমাদের আমলের বাবাদের শেখাতে হয় নতুন করে। কারণ উনারা দিতে অভ্যেস করেছেন।জীবন কে উপভোগ করার অভ্যেস টা হয়নি উনাদের।
তবে,বাবার শাসনে, এঘর থেকে ওঘরে গেলে লাইট,ফ্যান অফ করতে হতো বলে,কীভাবে যেন প্রয়োজন শেষে লাইট,ফ্যান অফ করা শিখে গেলাম আমরাও।
আমাদের বাবাদের খরচ বাঁচানো দেখে, আমরা কীভাবে যেন শিখে গেলাম রিক্সা ভাড়া বাঁচিয়ে শখের কিছু কেনাকাটা করা…।কীভাবে যেন আমরা একটু একটু বাবার ছায়া হয়ে গেলাম।
কথাগুলো খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে।কারণ সুতোয় বাঁধার সুযোগ নেই।বাবা মানে আমার কাছে কোন মহাপুরুষ কিংবা দেবতা নন। আমাদের বাবা, আমাদের মতোই আমাদের একজন বয়স্ক বন্ধু।আমাদের বাবা যেমন আমাদের শাসন করেন, আমরাও নিশ্চিন্তে বাবাকে শাসন করতে পারি,বিশেষত আমি।বাবার অনেক আচরণ আধুনিক মনস্ক হতে চাওয়া আমার পছন্দ হয় না।নারী স্বাধীনতা,ধর্মীয় সংস্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বাবার সাথে মতের অমিল হয়।পরিবারের বিভিন্ন জনের মন রাখতে গিয়ে এবং সামাজিক ভয়ে স্ত্রী-সন্তানের বিভিন্ন বিষয় এ উদাসীনতার দোষে আর দশজন বাবার মতো, আমার বাবা ও দুষ্ট।কিন্তু এসব দোষ কে উনার মহৎপ্রাণতা হিসেবে প্রচার করার কোন প্রয়োজন নেই।উনি যা, উনি তা ই।
আমার প্রাচীনপন্থী বাবা আমাদের শাসন মেনে নিয়ে কীভাবে যেন নিজেও আধুনিক হয়ে যান এক্ষেত্রে।কীভাবে যেন নিজেকে শুধরে নিতে থাকেন। শোধরাতে গিয়ে আবার ভুল করেন,আবার ঠিক করে নেন।আমার বাবা উনার যুগের আর দশ জন বাবার চেয়ে এখানেই এগিয়ে থাকেন।নিজেকে উনি আমাদের কাতারে আনতে পারেন।সবসময় উচ্চ আসনে আসীন হয়ে থাকেন না।আমাদের সাথে রাতের বেলা গল্পবলা বাবাটা ই তিনি এখনো।এখনো তিনি মন্ত্রবলা সেই বাবাটা।
এটাই আমাদের সেরা পাওয়া হয়তো,এই জন্মে 💜
একজন বন্ধুর মতো বাবা,
একজন দোষে গুণে মানুষ,
আপদে-বিপদে ছায়ার মতো সঙ্গী ,
সর্বাবস্থায় ‘আমি আছি রে মাই’ বলে অভয় দেওয়া স্বজন,
আমাদের বকা খেয়ে চুপ করে যাওয়া সন্তানের মতো বাবা পাওয়া আমাদের পরম ভাগ্য।
বাবা দিবসে বন্ধু বাবাকে শুভেচ্ছা।
আমরা সব সামাজিকতার দায় থেকে মুক্ত থেকে বাবাকে ভালবাসতে পারি,তাই না???
“প্রাপ্তেতু ষোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্র বদাচরেৎ”
— সন্তানের ষোল বছর হয়ে গেলেই বাবা আর সন্তান পরস্পর বন্ধুর মতো।একে অপরকে সম্মান করবেন।একে অপরকে প্রয়োজনে শাসন করবেন। একে অপরকে সম্পর্কে “স্পেস” দেবেন। বাবা দিবসে এটা ই আমার প্রার্থনা।সব বাবা যেন বন্ধু-বাবা হয়ে থাকেন 🙏
(পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা কিংবা দিব্যলোকে গমন করা সব বাবার জন্য ভালবাসা ও প্রার্থনা)।