বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠি আল জাজিরা টিভিতে এক ইন্টারভিউতে দাবী করেছেন, একজন ডাক্তার ও সায়েন্টিস হিসেবে তিনি দেখেছেন ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া কোন রোগীর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার কোন উপায় নেই। এমন অনেক রোগী দেখেছেন যাদের অপারেশন করেও বাঁচার সম্ভাবনা ছিলো না কিন্তু অলৌকিকভাবে তারা বেঁচে ফিরেছেন। এটা ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি প্রবলভাবে একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ। পৃথিবীর বড় বড় সব ডাক্তারও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কে বাঁচবে কে মরবে সেটা আমরা ডাক্তাররা ঠিক করে দেই না, সেটা একজন মহাজাগতিক ঈশ্বরই করে থাকেন…।
আল জাজিরাতে দেখা গেলো দেবী শেঠি তার হাসপাতালে অপারেশনের পোশাক পরে তার ঈশ্বরকে পুজা করছেন। মানে তিনি সার্জারি করার আগে উনার ঈশ্বরকে সন্তুষ্ঠ করে ওটিতে ঢোকেন। আমি মোটেই বিস্মিত হইনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের একজনের এ ধরণের হাস্যকর যুক্তি ও ধর্ম বিশ্বাস দেখে। কিন্তু উনাদের প্রবল মাত্রায় ধর্ম বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে একধরণের ”বৈজ্ঞানিক ভিত্তি” তৈরি করে। এরই হাত ধরে সমাজে ধর্মের নানা রকম কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, এমনকি ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি জনসাধরণের বিশ্বাসও চলে আসে। তাই দেবী শেঠির ধর্ম বিশ্বাস প্রচার ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের জন্য বড় বিজ্ঞাপন। আল জাজিরা মুসলমান শেখদের মিডিয়া হলেও একজন হিন্দু ডাক্তারের ”ঈশ্বরের” পক্ষে বড় সার্টিফিকেট ফলাও করার কারণ হচ্ছে, একজন “সায়েন্টিস” ঈশ্বর বলতে একজন কেউ আছেন মানছেন, এটার সঙ্গে মুসলমানরা যোগ করে নিবে- ”একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলাম” আর ”ইসলাম আসার পর অন্য সব ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে” দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাবে!
দেবী শেঠির বিশ্বাস ও কথিত যুক্তির বিষয়ে এবার বলি। দেবী শেঠির ঈশ্বরের কৃপাতেই যদি মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে তাহলে উনার সমস্ত ডাক্তারী বিদ্যাই কিন্তু বাতিল হয়ে যায়! প্রথমত হার্ট ভালো রাখতে তিনি যে পরার্মশগুলো দেন সেগুলোও কিন্তু বৃথা হয়ে যায়। তৈলাক্ত খাবার বর্জন, হাঁটাহাঁটি করা, লাল মাংস না খাওয়া, ধূপমাপ ত্যাগ করা সবই অর্থহীন কারণ একজন ঈশ্বরই সিদ্ধান্ত নেন কে হার্ট এ্যাটাক করবে আর কে সেটাকে দেবী শেঠির হাতে ওভারকাম করে বাড়ি ফিরবে। যদি বলেন, চিকিৎসা শাস্ত্র যেমন মানতে হবে তেমনি ঈশ্বরের হাত ছাড়াও আরগ্য লাভ সম্ভব নয় তাহলে দেবী শেঠির মত আধুনিক চিকিৎসা ও আধুনিক বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতির বদলে একজন গ্রাম্য কবিরাজের দাওয়াই নেয়াই তো যথেষ্ঠ! কেন ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খাওয়ানো হবে? ওতে কি আছে যে রোগীরা বিছানা ছেড়ে উঠে বসে? কলেরা বসন্তের টিকায় এমন কি আছে যেটা আল্লাহ ভগবান ঈশ্বরের নাম না নিলেও দিব্যি কাজ করে? একশ বছর আগে হার্টের রোগীরা যে অকাতরে মারত আজকের চিকিৎসা ব্যবস্থায় হার্টের সেসব সমস্যা কোন বিষয়ই না। মানুষ অসুস্থ হলে হাসপাতালের বদলে মন্দিরে নেয়া উচিত। খ্রিস্টান হলে গির্জাতে। মুসলমান হলে মসজিদে। এখানেই তো ঈশ্বর থাকেন। এগুলো ঈশ্বরের ঘর। যদি বলেন ঈশ্বরই বলেছেন রোগ হলে চিকিৎসা নেও। আমি বলব, যে এটা বলেছে তিনি আর যাই হোক ঈশ্বর নন আমাদের মতই মানুষ! কারণ কোন ঈশ্বর রোগ সারতে ডাক্তারের কাছে যেতে বলবে না। সাপুরে মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ ঝারার পরও কেন আধুনিক চিকিৎসায় হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করার ব্যবস্থা করল? সাপে কাটা রোগী তো সারাবে ইশ্বর! তিনি ওঝার উছিলা দিয়েই কাকে বাঁচাবেন আর কাকে বাঁচাবেন না সে সিদ্ধান্ত নিবেন। ব্যস মিটে গেলো। তাহলে শতকের পর শতক কেন বিজ্ঞানীরা জীবন যৌবন ল্যাবে বসে নষ্ট করছেন? দেবী শেঠির ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করেও শুধুমাত্র চিকিৎসা শাস্ত্রকে আস্থা রেখে কি রোগী সুস্থ হবে না? বড় বড় ডাক্তার সায়েন্টিস যদি ঈশ্বরের বিশ্বাস করে তাতে কি প্রমাণ হয়?
চিকিৎসা পেশাটা অন্যসব পেশার মতই ’কাস্টমার’ কেন্দ্রিক। উকিলদের মতই পেশেন্ট তাদের কাছে মক্কেল। যেসব দোকান মৃত্যুর পরবর্তী শৎকারের জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা যেমন কাস্টমারের আশায় বসে থাকে, ডাক্তাররাও কি মানুষের রোগের আশায় বসে থাকে না? যে ডাক্তারের প্রসার বেশি তিনি রোজগার করেন বেশি। তখনই ডাক্তারের হাতে নানা রঙের পাথর উঠে। আয় উন্নতি ভালো হওয়ার জন্য ডাক্তারদের চেম্বারে নানা রকম দুয়া কালাম লেখা ফ্রেম দেখা যায়। প্রসার ভালো হওয়ার জন্য পীর ধরা, বাবাজির শিষ্য হওয়া ডাক্তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। ডাক্তারি পরীক্ষার আগে ভারতের মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের মন্দিরে পুজা দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। বাংলাদেশের মেডিক্যাল ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি ধর্মান্ধ। ডাক্তার হওয়া মানে সমাজে সন্মান ও অর্থবিত্ত প্রতিপত্তি লাভ করা। এসব অর্জন করার মনোবাসনা যার বেশি তার তত ঈশ্বর আল্লাহ ভগবনের ভক্তি তত বেশি। দেবী শেঠির হাসপাতালে পুজা করার দৃশ্য অত্যন্ত দুঃখজনক আধুনিক মানুষ হিসেবে।কিন্তু একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সেটা ঠিকই আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরো উপমহাদেশেই ব্যবসা। সেই ব্যবসায় যার নিয়োজিত থাকবেন তারা তো মাদলি, দরগা, আল্লাহ, ভগবানে আস্থা রাখবেন বেশি সেটা আর অবাক কি?
সুষুপ্ত পাঠক