
জীবন অনন্ত দিনের জন্য নয়। এই অল্প সময়ের জীবনে চলার পথে কতজনের কাছে কতরকম উপদেশ আমরা পেয়ে থাকি। এই উপদেশের বেশিরভাগই আমরা ভুলে যাই, জীবনে প্রয়োগ করা হয়ে উঠে না। আবার সব উপদেশ নিজের জীবনের সাথে মেলে না। কিন্তু কিছু উপদেশ, বিশেষ কিছু কথা–মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য, ঘুরিয়ে দেয় জীবনের মোড়।
দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করে রাখা বিল গেটসও জীবনে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন মায়ের দেওয়া তিনটি উপদেশ।
বিল গেটস তখন বয়সে অনেক ছোট। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরলে মা গেটসকে জিজ্ঞাসা করলেন, “গেটস বাবা আমার, গণিত পরীক্ষায় কতো নাম্বার পেয়েছো?”
গেটস মাকে তার মার্কসের কথা বললেন। মা খুশি হয়ে বললেন, “বাহ! এতো ভাল নাম্বার তোমার ক্লাসে আর কয়জন পেয়েছে?”
গেটস মাকে বললেন, “আমি একাই পেয়েছি মা!”
মা বললেন, “বেশ বেশ! আমি অনেক খুশি হয়েছি যে তুমি একাই এই নাম্বার পেয়েছো। তুমি দশ–বিশ, চল্লিশ–পঞ্চাশ এমনকি আশি–নব্বই পাওনি। কিন্তু তুমি একদম শূন্য পেয়েছো! এবার নতুন করে এই শূন্য থেকেই শুরু কর সবকিছু। তবে তোমার জন্য তোমার মায়ের তিনটি উপদেশ রইলো–
১. প্রচুর বই পড়তে হবে। ক্লাসের পড়ার বাইরেও বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে বেশি করে জানবে, বেশি করে পড়তে হবে। আর নতুন নতুন সব বিষয়ের বই পড়বে, যেগুলো সচরাচর অন্যরা পড়ে না।
২. তুমি যেরকম চিন্তা করবে, তোমার জীবনও ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠবে। তাই সবসময় স্রোতের বাইরে একটু অন্যরকম করে চিন্তা করবে। সবার মতো হুজুগের পেছনে ছুটবে না। কখনো ছোট চিন্তা করবে না। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখবে, এতো বড় যেন নিজের কাছেই অসম্ভব লাগে, অন্যদের কাছে সে স্বপ্নের কথা বলতে ভয় হয়!
৩. জীবনে এমন কাজ করবে যা অন্য কেউ করছে না। বেশিরভাগ মানুষ ঘুরেফিরে প্রতিষ্ঠিত কিছু পথেই ক্যারিয়ার গড়ে তোলে, কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। তুমি সবার চেয়ে ভিন্ন পথে হাঁটবে, ভিন্ন কাজ করবে। তুমি নিজেই পথ তৈরি করবে, মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে।
সময় তখন ১৯৬৩ সাল। বিল গেটসের বয়স তখন আট বছর। তার মা স্কুল শিক্ষিকা মেরি ম্যাক্সওয়েল গেটস তাঁকে যখন এই উপদেশ তিনটি দিলেন তখন কেউ চিন্তাও করেনি এই তিনটি উপদেশ কীভাবে বিল গেটসের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবে একদিন, বিপ্লব বয়ে আনবে পৃথিবীজুড়ে, স্রোতের বাইরে গিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শেখাবে কোটি কোটি মানুষকে!
প্রথম উপদেশ: বই পড়া।
বিল গেটস এখনও প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে বই পড়েন। তাঁকে একবার এক অনুষ্ঠানে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “সুপারহিরোদের যেমন বিভিন্ন অতিমানবীয় ক্ষমতা থাকে, আপনি যদি সুপারহিরো হতেন আপনি কোন ক্ষমতা চাইতেন?”
সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি আরো দ্রুত বই পড়ে শেষ করার ক্ষমতা চাইতাম!”
বিল গেটস তাঁর সাফল্যের রহস্য হিসেবে এই বই পড়ার অভ্যাসকেই তুলে ধরেন। কারণ পৃথিবী এতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত যে, জ্ঞানের দখলে অন্যদের চেয়ে নিজেকে এগিয়ে না রাখলে টিকে থাকা অসম্ভব। এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে অনেকে ভুল করে। তারা প্রচুর বই পড়ে, কিন্তু সেখান থেকে শেখার জিনিস খুব কমই থাকে।
বিল গেটস বলেন, “আপনার বইয়ের বাছাই হওয়া উচিত আরও বিবেচনা প্রসূত, যে বইগুলো আপনার জীবনে অনন্য মূল্যবোধ যোগ করবে সেগুলো পড়া উচিত। বইটি পড়া শুরুর আগে আপনি যেমন ছিলেন, বইটি পড়ে শেষ করার পর আপনি একদম পরিবর্তিত একজন মানুষ হয়ে যাবেন। বাইরে থেকে দেখতে আগের মতোই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানসিকতায় বদলে যাবে অনেক কিছু।”
দ্বিতীয় উপদেশ: অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখা ।
ভেড়ার পালের গল্প নিশ্চয়ই সবাই জানা আছে। পালের সামনের ভেড়াগুলোকে পেছনের ভেড়াগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ করতে থাকে। রাখালের পাহারাও দিতে হয় না। বাস্তব জীবনেও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা অনেকেই সেই ভেড়ার পালের মতোই গণ্ডিবদ্ধ কিছু চিন্তাভাবনায় আটকা পড়ে আছি। সমাজ যা বলে, পরিবার যা চায়– আমরা তার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না অনেক ক্ষেত্রেই। এজন্য পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে কমন অজুহাত হলো, “লোকে কী বলবে?”, “আমার বাবা–মা এটা মেনে নিবে না!” ইত্যাদি। আমরা কবে এই অজুহাতের বেড়াজাল ভেঙ্গে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে শিখবো?
তৃতীয় উপদেশ: নতুন কিছু করা।
আইনস্টাইন বলেছেন, “বোকামি হলো সেটাই– যখন মানুষ ঘুরেফিরে একই কাজ করে যায় সবার মতো, আর আশা করে ভিন্ন ফলাফলের।”
জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে অনেকেই, “Mediocrity” অর্থাৎ মধ্যম অবস্থার গণ্ডি ভেঙে সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর স্বপ্ন। সফল উদ্যোক্তা গ্যারি ভেইনারচাক এর কাছে একবার কিছু তরুণ এলো যারা সবাই তাঁর মতো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সবাই ঘুরেফিরে নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার গল্প করছে হঠাৎ গ্যারি সবাইকে একটি প্রশ্ন করলেন, “গত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সবাই কে কী করেছে?”
একেকজনের একেক উত্তর– কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিশ্রাম নিয়েছে, কেউ বিনোদনে কাটিয়েছে। গ্যারি মুচকে হেসে বললেন, “তোমরা এই এক শুক্রবারে যে পরিমাণ ছুটি কাটিয়েছো আমি গত পাঁচ বছরেও সে পরিমাণ ছুটি কাটাইনি! ছুটির দিনে আমি আরও বেশি করে কাজ করি। সুতরাং আমাকে কীভাবে ছুঁতে পারবে সে চিন্তা না করে নিজেকে আরো পরিশ্রমী করে তোলায় মনোযোগ দাও।”
ভিন্নপথে, নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটতে চাওয়ার ঝুঁকি অনেক, তাই পরিশ্রমও করতে হবে আর সবার চেয়ে বেশি, কিন্তু একবার সাফল্যের দেখা পেয়ে গেলে যেই তৃপ্তি, যেই গৌরব অনুভব করবে, তার সাথে পৃথিবীর আর কোনকিছুর তুলনা হয় না!
তথ্যসূত্র: