হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। ভারত ও নেপালের পরে বাংলাদেশে সর্বাধিক সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। দেশভাগ ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেলেও এখনও বাংলাদেশে অনেক প্রাচীন হিন্দু মন্দির রয়ে গিয়েছে। যদিও এগুলির অধিকাংশই বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষয়িষ্ণু ও জরাজীর্ণ অবস্থায় ধ্বংসের দিন গুনছে। মুসলিম আধিপত্যের কারণে এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জমি সংক্রান্ত লোভের কারণে হিন্দু মন্দিরগুলোর অধিকাংশ জমি বেদখল হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকলেও এখনও বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির, আশ্রম বা আখড়ার সংখ্যা এক লাখের উপরে।দেখে নিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ১০০টি হিন্দু মন্দিরের ছবির মধ্যে ২০টি ছবি।
কৃতজ্ঞতা: Temples with Atanu
অসাধারণ কিছু দুষ্প্রাপ্য ও বিরল ভিডিও দেখুন এখানে https://www.youtube.com/c/TempleswithAtanu

রাজারাম মন্দির, মাদারীপুর
মাদারীপুর জেলায় অবস্থিত রাজারাম মন্দির বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন মন্দির ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।
কালীসাধক রাজারাম রায় চৌধুরী নামক তৎকালীন খালিয়া জমিদার বংশ ১৭শ শতকে রাজারাম মন্দিরটি এই অঞ্চলে নির্মাণ করেন। মন্দিরটি নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে অনেকেই মনে করেন এটি ১৮২৫ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল। জমিদার রাজারামের নামানুসারেই মন্দিরটির নাম রাখা হয় ‘রাজারাম মন্দির’।
মন্দিরটিতে মোট ৯টি কক্ষসহ একটি রান্নাঘর রয়েছে যার মধ্যে নিচের তলায় তিনটি ও উপরের তলায় ৬টি কক্ষ। এছাড়াও পূজা অর্চনার জন্য রয়েছে আলাদা স্থান। রাজারাম মন্দিরের উচ্চতা ৪৭ ফুট। দ্বিতল এই মন্দিরটির প্রতিটি দেয়াল বিভিন্ন রকম দেবদেবী, রামায়ণ ও মহাভারতের নকশা ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।

গোলকধাম মন্দির, পঞ্চগড়, রংপুর
গোলকধাম মন্দির বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে অবস্থিত একটি প্রাচীন স্থাপনা। এটি মূলত পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন মন্দির।
মন্দিরটি একটি প্রাচীন উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর স্থাপিত ছয় কোণাকার মন্দির। এর অভ্যন্তরে একটি কক্ষ আছে। মন্দিরটির গায়ে এর নির্মাণকাল ১৮৪৬ সাল উল্লেখ আছে। মন্দিরটি অষ্টাদশ শতকের স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শণ। এই স্থাপত্য কৌশল গ্রীক পদ্ধতির অনুরূপ। মন্দিরটি গোলককৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয় এবং তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়।

মানিকগঞ্জের একটি শিবমন্দির বটগাছের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে ধ্বংসের দিন গুনছে।

যোগীর ভবন, কাহালু, বগুড়া
যোগীর ভবন বগুড়ার কাহালু উপজেলায় অবস্থিত একটি মন্দির। এটি প্রায় ৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
জনশ্রুতি আছে এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগী ও সাধু-সন্নাসীদের যাতায়াত ছিল বলে এ স্থানটির নামকরণ ‘‘যোগীর ভবন’’।
এখানে একটি আশ্রম, ০৪ টি মন্দির, কানচ কূপ, একটি ইঁদারা, ধর্মটঙ্গী এবং অগ্নিকুন্ড ঘর রয়েছে। চারটি মন্দিরের নাম হচ্ছে সর্বমঙ্গলা, দুর্গা, কালভৈরবী এবং গোরক্ষনাথ। এর মাঝে সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি নকশাকৃত ইট ও পোড়ামাটির ফলক দ্বারা ব্যাপকভাবে অলঙ্কৃত। যোগীর ভবনের আশ্রম ও মন্দির নির্মানের তেমন কোন নির্দিস্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এখানকার বিভিন্ন দেয়ালের গায়ে লেখা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি ৮৮৪ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে জানা যায় বাংলার কিংবদন্তী নায়িকা বেহুলার মৃত স্বামী লক্ষিন্দর এখানকার কূপের জলের মাধ্যমে জীবন ফিরে পেয়েছিল।

ভোলাহাট গ্রামের শিব মন্দির, চাঁপাই-নবাবগঞ্জ
চাঁপাই-নবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট গ্রামে দ্বাদশ শতাব্দীতে (১১৫৬-১২০৬) নির্মিত অতি প্রাচীন শিব মন্দির আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। এই মন্দিরটিকে স্থানীয়রা চামচিকা মন্দির বলে থাকেন। উত্তরের গৌড়িয়া ইটের তৈরী মন্দিরটি অতি প্রাচীন। পোড়া মাটির ফলক ও নকশাগুলি অযত্নের কারণে মন্দিরের গা থেকে খসে পড়েছে অনেক আগেই। মন্দিরটির ভিত্তি ক্ষয় হয়ে গিয়েছে অনেকাংশে। স্থানীয় অধিবাসীরা এখন মন্দিরের গায়ে গোবর-চাপড়া লাগিয়ে শুকায়।

রাজরাজেশ্বরী মন্দির, বলিহার জমিদার বাড়ি, নওগাঁ
বলিহার রাজবাড়ী নওগাঁ সদর উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীনতম রাজবাড়ী এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
বলিহারের জমিদার রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার অন্যতম বিখ্যাত জমিদার ছিল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে নওগাঁর বলিহার এলাকার এক জমিদার জায়গির লাভ করেছিলেন। ১৮২৩ সালে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ এখানে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তিনি মন্দিরে পিতলের তৈরি রাজেশ্বরী দেবীর একটি মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। মূর্তিটি এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল।
দেশ বিভাগের সময়কালে বলিহারের রাজা ছিলেন বিমলেন্দু রায়। দেশ বিভাগের সময় জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে বলিহারের রাজা বিমলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর বলিহার রাজবাড়ী ভবনটি দেখভাল করেন রাজ পরিবারের অন্যান্য কর্মচারীরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে রাজবাড়ির বিভিন্ন নিদর্শন, আসবাবপত্র, জানালা দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট হয়ে যায়।
রাজবাড়ীর সামনেই রয়েছে রাজ-রাজেশ্বরী মন্দির। যদিও মন্দিরের দেয়ালের কারুকাজ, মূল্যবান রিলিফের কাজগুলো এখন অস্পষ্ট ও ভাঙ্গা। এই কারুকাজগুলো ছিল এই মন্দির গুলোর শোভাবর্ধক।

শিব-কালী জোড়া মন্দির, ময়মনসিংহ
মুক্তাগাছা শিব মন্দির বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় মুক্তাগাছার রাজবাড়ির বাইরে অবস্থিত একটি জোড়া মন্দির। মন্দিরটি মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর মাতা রাণী বিমলা দেবী কর্তৃক ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনি মুক্তাগাছা শহরের কালীবাড়ি এলাকায় ১৮২০ সালে শ্রী আনন্দময় শিব ও আনন্দময়ী কালীমাতা মন্দির নামে পাশাপাশি দুটি মন্দির স্থাপন করেন। তৎকালীন সময় থেকে একটিতে রাখা হয় শিবলিঙ্গ। অন্যটিতে রাখা হয় অনন্তময়ী কালী মূর্তি। দুটি মন্দিরেই পূজা অর্চনা করা হয়। এখনও রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। জোড়া মন্দির হিসেবেই পরিচিত এটি। এর উচ্চতা প্রায় ৯০ ফুট। নিপুণ কারিগর দ্বারা এটি স্থাপন করা হয়েছে। এশিয়া মহাদেশে আকর্ষণীয় একটি মন্দির। কালের আবর্তে এটি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।

শিব মন্দির (ক্ষিতিশ চন্দ্রের মঠ), পুঠিয়া, রাজশাহী
কৃষ্ণপুর শিব মন্দির বা ক্ষিতিশ চন্দ্রের মঠ, পুঠিয়া, রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত একটি প্রাচীন স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত।
পুঠিয়া বাজারের ১ কিলোমিটার পশ্চিমে কৃষ্ণপুর গ্রামে ছোট আকৃতির এ মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে ক্ষিতিশ চন্দ্রের মঠ হিসাবে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি শিব মন্দির। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের দক্ষিণ ও পূর্ব দেয়ালে একটি করে খিলান দরজা আছে।

পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, টাঙ্গাইল
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ী টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি জমিদার বাড়ী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিম বঙ্গ কলকাতা থেকে আসেন রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল (ধনাঢ্য ব্যক্তি)। তিনি পাকুটিয়ায় জমিদারী শুরু করেন। প্রায় ১৫ একর এলাকা জুড়ে একই নকশার পর পর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা নির্মাণ করা হয় (১৯১৫)। তখন জমিদার বাড়িটি তিন মহলা বা তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল।
এই অট্টালিকাগুলি পাশ্চাত্য শিল্প সংস্কৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, যার লতাপাতার চমৎকার কারুকাজগুলি মুগ্ধ করার মতো। এছাড়া পূজা মন্ডপের শিল্পিত কারুকাজ শতবছর পর এখনও পর্যটককে মুগ্ধ করে।

কেষ্ট ক্ষ্যাপার মঠ, রাজশাহী
কেষ্ট ক্ষ্যাপার মঠ বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত একটি প্রাচীন স্থাপনা। এটি মূলত রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার অন্তর্গত রামজীবনপুর গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মঠ।
কেষ্ট ক্ষ্যাপার মঠটি একটি প্রাচীন চারকোণা মঠ। এর অভ্যন্তরে একটি একটি কক্ষ রয়েছে। বর্গাকারে নির্মিত এর দক্ষিণ দেয়ালে ১টি মাত্র প্রবেশপথ আছে এবং উপরে ২৫টি মৌচাকৃতির ছাদ দ্বারা আবৃত। মন্দিরটি ১৮শ শতকের শেষ দিকে নির্মিত বলে ধারনা করা যায়।

নড়াইলের শালনগর চাকলানবিশ পরিবারের (বাবু বাড়ী) শিব মন্দির।

ধনুকা মনসা মন্দির, শরীয়তপুর
ধনুকা মনসামন্দির শরীয়তপুর জেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির ও বাংলাদেশের অন্যতম একটি সরক্ষিত পুরাকীর্তি। এটি শরীয়তপুর সদরের ধানুকা নামক গ্রামে অবস্থিত। মন্দিরটি ময়ূর ভট্টের বাড়িতে অবস্থিত। এ বাড়িতে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। সবগুলো মন্দির নিয়ে গঠিত বাড়িটিকে একত্রে স্থানীয়রা ময়ূর ভট্টের বাড়ি নামে ডেকে থাকেন।
আনুমানিক প্রায় ৬ শত বছর পূর্বে ধানুকা অঞ্চলে মনসাবাড়িটি তৈরি করেন তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যক্তি ময়ূর ভট্ট। পরবর্তিতে তার বাড়িতেই তিনি মনসা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মনসা মন্দিরটি তৎকালীন এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ছিল ও ভারত থেকে এখানে পূজা দেওয়ার জন্য লোক সমাগম হত। মনসা মন্দিরের জনপ্রিয়তার কারণে পুরো বাড়িটিই মনসা বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
মন্দিরটিতে পিতলের তৈরি পুরাতন একটি মনসা মূর্তি রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মন্দির তথা বাড়িটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বিভিন্ন সময় বাড়ি তথা মন্দির থেকে প্রাচীন পুথি উদ্ধার করা হয়েছে।

সোনারং জোড়া মঠ, মুন্সীগঞ্জ
সোনারং জোড়া মঠ বাংলাদেশের অষ্টাদশ শতাব্দীর এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে অবস্থিত। কথিত ইতিহাসে জোড়া মঠ হিসাবে পরিচিত লাভ করলেও মুলত এটি জোড়া মন্দির।
সোনারং গ্রামে এক সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। মন্দিরের একটি প্রস্তর লিপি থেকে জানা যায় এলাকার রূপচন্দ্র নামে এক হিন্দু বণিক বড় কালীমন্দিরটি ১৮৪৩ সালে ও ছোট মন্দিরটি ১৮৮৬ সালে নির্মাণ করেন। ছোট মন্দিরটি মূলত শিবমন্দির। বড় মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার। কথিত আছে, শ্রী রূপচন্দ্রের অন্ত্যষ্টিক্রিয়া এখানেই হয়েছে।

পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির, পুঠিয়া, রাজশাহী
রাজশাহী শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিখ্যাত পুঠিয়া রাজবাড়ির সবচেয়ে কাছে এই মন্দিরের অবস্থান। গোবিন্দ মন্দির ১৮২৩ থেকে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রাণী ভুবনময়ী দেবী কর্তৃক নির্মিত হয়। রাজবাড়ির পেছনের অংশে এই মন্দিরের একমাত্র মূল প্রবেশপথ। মন্দিরের পেছনে মহারাণীর স্নানঘাট।
মন্দিরটি মূলতঃ ইট দ্বারা নির্মিত, বহিঃদেওয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির চিত্রফলক। এসব চিত্রফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চরত্ন স্থাপত্য পরিকল্পনায় এ মন্দিরের চারকোণে চারটি ও কেন্দ্রে একটি করে মোট পাঁচটি শিখর বা রত্ন আছে। শিখরগুলো ক্ষুদ্রাকার, চৌচালা আকারে নির্মিত। প্রথম তলার প্রতি পাশে ৩টি করে প্রবেশ পথ রয়েছে, প্রতিটি প্রবেশপথের উপরাংশে রয়েছে বহুমুখী খিলান। মন্দিরের ছাদের কোণগুলো আংশিক বাঁকানো।

শিব-পার্বতী মন্দির, সিরাজগঞ্জ
হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দিরের উত্তর পাশে অবস্থিত পোড়ামাটির কারুকার্যখচিত শিব-পার্বতী মন্দির।

গোপীনাথ জিউর মন্দির, কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতার ভোগবেতালে অবস্থিত শ্রীশ্রী গোপীনাথ জিউর মন্দির। প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক এই মন্দির হিন্দু ধর্মীয় অনুসারীদের তীর্থস্থান। সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। কিংবদন্তী আছে, ঊড়িষ্যার শ্রীশ্রী জগন্নাথ বঙ্গের শ্রীশ্রী গোপীনাথ। মন্দিরে প্রায় ষোড়শ শতাব্দী থেকে শ্রীশ্রী গোপীনাথ, বলরাম ও সুভদ্রার সেবা পূজা আজও চলে আসছে।
জনশ্রতিতে আছে, ষোড়শ শতকের বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম এবং প্রধান ভাটি রাজ্যের অধিপতি ঈশাখাঁ মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার পথে থেকে মন্দিরের ভোগ আরতির সুঘ্রাণে যাত্রা বিরতি করেন এবং এই মন্দিরের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে মন্দিরের জন্য লাখেরাজ ভূমি দান করেন। আর তখন থেকেই এলাকার নামকরণ করা হয় ভোগবেতাল।
কিশোরগঞ্জের ষোড়শ শতকের কবি নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস গ্রন্থে উল্লেখ, মহাপ্রভূ চৈতন্যদেব পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুর হয়ে আচমিতার বৈষ্ণব লক্ষীনাথ লাহিড়ীর আথিত্য গ্রহণ করেন। চৈতন্যদেব ৩/৪ দিন ভোগবেতাল মন্দিরে নাম সংকীর্তন পরিবেশন করেছিলেন।
গোপীনাথ বাড়ি ৪২০ বৎসর পূর্বে পূর্ববঙ্গে সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ রথযাত্রা শুরু হয়। ১০৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ৩২ চাকার রথ ১ কিঃ মিঃ দীর্ঘ নিজস্ব সড়কে গুন্ডিচাবাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) মন্দির থেকে গোপীনাথ ভক্তবৃন্দ আনা-নেয়া করতো। তিনটি রথের একটি পিতলের অন্য দুটি কাঠের তৈরি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যে এটিই একমাত্র দূরপাল্লার রথযাত্রা । কালক্রমে ২৪, ১৬ এবং বর্তমানে ৯ চাকার রথটি তৈরি হয়েছে।
এখনো অতীত ঐতিহ্য, স্মৃতি নিয়ে শ্রীশ্রী গোপীনাথ জিউর মন্দির দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

খেলারাম দাতার মন্দির, নবাবগঞ্জ
খেলারাম দাতার মন্দির বা খেলারাম দাতার বিগ্রহ মন্দির ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির।
মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এর নির্মাণশৈলী দেখে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের ধারণা এ স্থাপনাটি উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নির্মিত হয়েছিল।
কিংবদন্তী অনুসারে, খেলারাম দাতা ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত ডাকাত সর্দার। তিনি ইছামতি নদীতে ডাকাতি পরিচালনা করতেন। জনশ্রুতি অনুসারে, ডাকাতির ধনসম্পদ তিনি ইছামতি নদী থেকে সুড়ঙ্গপথে তার বাড়িতে নিয়ে রাখতেন ও পরবর্তীতে সেগুলো গরীবদের মাঝে দান করতেন। তিনি পূজা-অর্চনার জন্য একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। সেই থেকে মন্দিরটি খেলারাম দাতার বিগ্রহ মন্দির নামে পরিচিত।
মন্দিরটিতে নির্মানকৌশলে বঙ্গীয় বা গৌড়ীয় রীতির প্রতিফলন রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ধারা। পুরো কমপ্লেক্সটি আটকক্ষ বিশিষ্ট একটি দ্বিতল ভবন। বর্তমানে ভবনটির শুধু ওপরের দোতলা টিকে রয়েছে। নিচতলায় অনেকগুলো কক্ষ থাকলেও এখন প্রায় সবই মাটিতে ঢেকে আছে। ভবনের ভারী দেয়াল ও পিলার দেখে নির্মাণকৌশল সম্পর্কে ধারণা করা যায়। দোতলার চারপাশে ও চার কোণে রয়েছে বাংলা ঘরের আকৃতিতে এক কক্ষবিশিষ্ট আটটি ঘর। মাঝে মঠ আকৃতির আরেকটি ঘর রয়েছে। ঘরটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জনশ্রুতি অনুসারে, প্রাপ্ত অনেক মূল্যবান মূর্তি ও ধনসম্পদ তিনি এখানে লুকিয়ে রাখতেন।

কোদলা মঠ, বাগেরহাট
কোদলা মঠ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত একটি মঠ। এই প্রত্নতাত্ত্বিক অবকাঠামোটি আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। এ মঠের নাম কোদলা মঠ হলেও স্থানীয়ভাবে অযোধ্যা মঠ নামেও পরিচিত।
মঠটিতে খোদাই করা একটি লেখা রয়েছে। স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় লেখাটি ছিল ‘শর্মনা উদ্দিশ্য তারকং(ব্রক্ষ্ম) [প্রশা] দোহাং বিনির্মিত:।।’
সংক্ষিপ্ত ও খন্ডলিপিটির সঠিক অর্থ নিরুপন করা না গেলেও যতদূর পাঠোদ্বার করা যায় তা থেকে অনুমান করা হয় “তারকের (জনৈক ব্রাহ্মণ কার্তিক) প্রাসাদ বা অনুগ্রত লাভের জন্য এ মঠটি সম্ভবত একজন ব্রাহ্মণ (শর্মনা) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। মঠের নির্মাণ নিয়ে যে সকল তথ্য জানা যায় এবং সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের উদ্যেগে তার গুরু (সভাপন্ডিত) অবিলম্ব সরস্বতীর স্মতিস্তম্ভ হিসাবে মঠটি নির্মান করা হয়।
জানা যায়, সে সময় সমগ্র বাগেরহাট রাজা প্রতাপাদিত্যের শাসনাধীন ছিল। প্রতাপাদিত্য বহু পন্ডিতকে বৃত্তি দিতেন। প্রতাপাদিত্যের সভাপন্ডিতদের মধ্যে অন্যতম প্রতাপাদিত্যর বন্ধুকবি অবিলম্ভ সরস্বতী। তিনি মুখে মুখে দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন বলে তার নাম অবিলম্ব সরস্বতী হয়েছিল।

ছোট শিব মন্দির, পুঠিয়া, রাজশাহী
ছোট শিব মন্দির রাজশাহীর, পুঠিয়া উপজেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন মন্দির।
মন্দিরটি ইট, চুন, সুরকি দিয়ে বর্গাকারে নির্মিত। ছোট আকৃতির এ মন্দিরের একটি মাত্র কক্ষ রয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণ দেয়ালে ১টি মাত্র প্রবেশপথ আছে। মন্দিরের কার্নিশগুলো পোড়ামাটির অলংকরণদ্বারা সজ্জিত এবং আংশিক বাঁকানো।
মন্দিরে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এটি ১৮০০ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত।

নদীয়া রাজবংশের স্মৃতিচিহ্ন, ভবানন্দের প্রতিষ্ঠিত মন্দির, মেহেরপুর
মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী বাগোয়ান গ্রাম এক সময়ে ছিল মোগল আমলের ১৮টি পরগণার রাজধানী। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার। যার বাল্য নাম ছিল দুর্গাদাস সমাদ্দার।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার এই বিশাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা পরে নদীয়া রাজবংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ভবানন্দ মজুমদার ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত বাগোয়ান-ভবানন্দপুরে রাজবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন। ভবানন্দ মজুমদারের নামে ভবানন্দপুর গ্রাম প্রতিষ্ঠা পায়। ভবানন্দপুর রাজবাড়ীটিকে এলাকাবাসী কাছারী হিসেবে চিনতো। তবে এখন তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
ভবানন্দপুর গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে, যা স্থাপন করেন ভবানন্দ মজুমদার। মেহেরপুরের ভবানন্দপুর মন্দিরটি নদীয়া রাজবংশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদরা। এখনো মন্দিরটি ভগ্নপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়েছে।