বীরভোগ্যা বসুন্ধরা : মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি বাঙ্গালী হিন্দুরা।

অনিমিত্র চক্রবর্তী

 ১৯৩৮এ কলকাতা মহানগরীতে প্রকাশ্য দিবালোকে মূসলিম লীগের মৌলানা আক্রমণ খাঁর নেতৃত্বে ঘটেছিল ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ – এর বহ্নুৎসব। শত শত কপি পোড়ানো হয়েছিল কিন্তু তীব্র, মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি বাঙ্গালী হিন্দুরা।


২০২২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবর্ষে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার মূলসূত্র হবে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী – হিন্দু রক্তে যার গলি থেকে রাজপথ লাঞ্ছিত হয় প্রতি মুহূর্তে। তীব্র, মৌখিক প্রতিবাদ বিনা কিছু নেই করার বাঙ্গালী হিন্দুর।
১৯৯০ সালের ১৯শে জানুয়ারি – আজ, অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল কাশ্মীর উপত্যকায়: প্রারম্ভ হয়েছিল কাশ্মীরের পন্ডিতদের নারকীয় গণহত্যা, গণধর্ষণ ও বীভৎসতা ঐসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। ফলতঃ পলায়ন। হিন্দু – সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবর্ষ বিমূঢ় রূপে প্রত্যক্ষ করেছিল সেই অসহায়তা, তাকে পরাস্ত করার সংকল্প আসেনি মনের গহীনে।
সমগ্র বিগত সহস্রাব্দে ও এই মূহুর্তেও হিন্দুর উপর অত্যাচার চলে নির্দ্বিধায় – ধর্ম, ভাষা, জনপদ ও কুলের ভিত্তিতে।….. অতএব, সমস্যা রয়েছে আক্রান্তের মধ্যে, হিন্দুর মধ্যে তার defeatist psychology তে, আক্রমণকারীর পৈশাচিক নির্যাতনের মধ্যে নয়। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম পঞ্চতত্ত্বের মতোই তা স্বাভাবিক, যেমন স্বাভাবিক হিন্দুর মানসিক স্থবিরতা।….. সহস্র বৎসর পরেও তা কূপের মন্ডুকের ন্যায়। দোষ কোথায়? সমস্যা কোথায়? পতন কেন অবশ্যম্ভাবী হয় প্রতি মুহূর্তে – তা কি অধ্যাত্মবাদের অনুসরণে সদা ব্যস্ত ও আপ্লুত (প্রকৃত অর্থে পালন নয়) হিন্দু অনুধাবন করে? উত্তরঃ – না।
কেন করে না? এর মূল কারণ, অনুসরণ সহজ, পরামুখাপেক্ষী হয়ে থাকা, নির্ভরশীলতার মধ্যে আছে দায়হীন রূপে বাঁচার স্ফুর্তি ও স্বাধীনতা। দোষ অন্যের, আমি নিমিত্ত মাত্র। সে আক্রান্ত বা ভাগ্যহীন হওয়াই হোক বা দরিদ্র। মোগল, পাঠান, পর্তুগীজ, ইংরেজ, গান্ধী, নেহরু, কংগ্রেস, জিন্না, সুরাবর্দী, নাজিমুদ্দিন, কম্যুনিস্টকে দোষ দিয়ে ও পরে তার শরণাপন্ন হয়ে হিন্দু ব্যর্থ হল বুঝতে হারল সে কোনখানে।
১৯৪৬-৪৭-এ বিধ্বংসী লড়াই করেও প্রায় সকল হিন্দু যোদ্ধা তাঁর স্বীয় শস্ত্র সমর্পণ করেছিল স্থানীয় থানা, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের নিকট। তার মধ্যে ছিলেন অগণিত হিন্দু মহাসভার কর্মীও। তাঁদের কাছে সমগ্র ঘটনাবলী ছিল exceptional/আকস্মিক, তাই তাকে প্রতিহত করেই দায়িত্ব শেষ। হিংসা প্রক্ষিপ্ত, তাই তার পালা শেষ হলে অনন্ত শান্তির জন্য রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্র নিষ্পেষণ আরম্ভ করলে? মৃত্যু ও পলায়নই একমাত্র উত্তর ও পথ। তাহলে হিংসার চর্চা করে না কেন হিন্দু? শস্ত্রের পূজা হয় না কেন? শাস্ত্রের পাশে শস্ত্রের আশ্রম গড়ে ওঠে না কেন হিন্দু সমাজে? শাস্ত্রমতে তাও তো কর্তব্য ও অনিবার্য।… মহারাজ আদিশূরের আহ্বানে কান্যকুব্জ হতে পঞ্চ বিপ্রের বঙ্গে আগমন হলে তাঁদের চিনতে পারেননি রাজ সভাসদেরা। তাঁরা সশস্ত্র ও যোদ্ধৃবেশে ছিলেন বলে: ধনুঃ, তূণ ও তীক্ষ্ণ তরবারি সহ।
এটিই মূল প্রশ্ন হিন্দুর অস্তিত্বরক্ষার্থে ও আগামী হেতু। যাঁরা এইসবের – অধ্যাত্মবাদ ও বস্তুবাদের প্রকৃত ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় নব জাগরণের সেই সকল বরেণ্য সন্তানকে অতি নিপুণতা ও কৌশলের সাহায্য ভারতবর্ষ তথা বঙ্গের academia থেকে মুছে দিয়েছে কম্যুনিস্ট বিচারধারা, নেহরুবাদী কংগ্রেসের প্রকৃষ্ট ও প্রচ্ছন্ন সমর্থনে। এবং তাঁদের restoration/প্রত্যয়র্পণ/পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ন্যূনতম উদ্যোগ দৃষ্ট হয়নি এবং হবেও না – এটি শাশ্বত সত্য। কেন? তা করতে গেলে maturity – এর প্রয়োজন তা নেই। অধিকারী হতে হয় সর্বপ্রথম। প্রমাণ? ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু গণহত্যার পরে হিন্দুদের মধ্যে ধুতি পড়া লোপ পায়: পশ্চিমবঙ্গে তা থেকে যায়। কিন্তু ওপারে লোপ পাওয়ার যন্ত্রণা এপারে বিদ্ধ করে না: ওপারের identity crisis এপারের identity consciousness বৃদ্ধি করে না – ধুতি পাঞ্জাবী পড়া বাঙ্গালী হিন্দুর জাতীয়তাবাদী রক্তে আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রবেশ করানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছিল বলে। এখানেই হিন্দু সমাজের নিকৃষ্টতা – বঙ্গ বা কাশ্মীর মিশে যায় একত্রে। আক্রান্ত হিন্দু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধে মুখরিত হয় না: আজকাল অবশ্য অনলাইন ঘৃণা প্রকাশ করেই তাতে ইতি টেনে নতুন বিষয়ে মেতে ওঠে। ঘৃণার সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা নেই।…
কবে হিন্দু বুঝবে যে ধর্ম মানেই ষোড়শপচারে পূজা আর গদগদ ভক্তি নয়? তার জন্য আর কত হিন্দু রক্তের প্রয়োজন? কবে হিন্দুর বোধগম্য হবে যে শুক্রাচার্য, দেবগুরু বৃহস্পতি, রামায়ণ, মহাভারত, কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র, কামন্দকীয় নীতিসারে বর্ণিত রাষ্ট্ররক্ষার্থে অনুসৃত (বা অনুসরণযোগ্য) কাঠিন্যের পথ, নিষ্ঠুরতার পথও ধর্ম। কবে হিন্দু স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি ‘কুযুক্তি দমন করিতে চাবুক ছাড়া গত্যন্তর নাই’ – এর মর্মার্থ?
এটিই আদ্যন্ত ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ – হিন্দুর আজ এক ভয়ঙ্কর স্বামী সত্যানন্দ, শ্রী ভবানী পাঠকের প্রয়োজন যাঁরা নেতৃত্ব দেওয়ার সাথে চাবকে অধঃপতিত/স্বধর্মচ্যুত হিন্দু সমাজকে সিধে করতে পারবেন। এবং তাঁদের পথ সুগম করার জন্য বাঙ্গালী হিন্দু সমাজকে গড়তে হবে সেই সমাজ যেখানে হাতে হাতে থাকবে শস্ত্রাচার্য শ্রী পুলিনবিহারী দাসের ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’ যাতে পাঠ নেবেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ও যুবকদের status symbol হবে দেওয়ালে ঝোলা chest expander..
ছদ্ম হিন্দুকে প্রকৃত হিন্দু হওয়ার সাধনা করতে হবে সসাগরা ভারতবর্ষে – চরিত্র, প্রতিরোধের স্পৃহা আগ্নেয় হতে হবে নতুবা অগ্নিতেই ভস্মীভূত হতে হবে – যা হয়ে চলেছে একাদিক্রমে। ন্যায়ের পরাক্রমে নিশ্চিহ্ন হবে অন্যায়ের প্রাবল্য।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।।…..
অনিমিত্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *