ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণাঃ
ষাটের দশকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আবার নতুন করে যড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৬০-৬১ সালে রবীন্দ্র শতজন্মবার্ষিকী পালনে সরকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তৎকালীন দৈনিক আজাদ। সরকার সমর্থক এই পত্রিকাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ,বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপত্তিকর সংবাদ ও বিবৃতি প্রকাশ করে। এই জঘন্য ভূমিকা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে দৈনিক ইত্তেফাক। ইত্তেফাক যথাযথ জবাব ও যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, বাঙালির গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখে।
এই সময় (১৯৫৮-৬২) সমগ্র পাকিস্তানে পূর্ণ সামরিক আইন বলবৎ এবং শেখ মুজিব কারারুদ্ধ থাকায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে কাজ করে। ছাত্র সংগঠনগুলো আইউবশাহীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে এবং রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, বাংলা নববর্ষ প্রভৃতি পালনের মাধ্যমে বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করে।
১৯৬২ সালে জেলখানা থেকে মুক্ত হয়েই শেখ মুজিব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুরুজ্জীবিত করে তিনি বলেন, “ভোটাধিকার না দিলে জনগণ ট্যাক্স দেবে না। আওয়ামী লীগ বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ডিক্টেটর আইউবশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।”
ষাটের দশকের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আর্থ-রাজনৈতিক শোষণের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করলে শেখ মুজিব বাধ্য হয়েই ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ৬-দফার জনপ্রিয়তায় আইউব খান ক্ষিপ্ত হয়ে একে বিচ্ছিন্নতাবাদের চক্রান্ত ও ‘অন্ত্রের ভাষা’ ব্যবহারের হুমকি দিলে শেখ মুজিবও ঘোষণা করলেন ‘আমার জনগণ অস্ত্রের ভাষার যথার্থ জবাব জানে’। মুজিব গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের প্রতিবাদে জনগণ হরতাল পালন করে এবং রেললাইন উপড়ে ফেলে। ঐদিন (১৯৬৬,৭ জুন) পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত ও নাটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলার প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংবাদিক ও শিক্ষাবিদগণ এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং একটি যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে যারা সই করেন তাদের মধ্যে ছিলেন-ড, কুদরত-ই- খোদা, ড, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, এম. এ. বারী, অধ্যাপক আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. আহমদ শরীফ, কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ড. মোঃ মনিরুজ্জামান এবং শহীদুল্লাহ কায়সার। বিবৃতিতে তারা দাবি করেন যে, রবীন্দ্রনাথ, ‘বাংলা ভাষাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই প্রতিবাদ শুধু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি বন্দী ছিলেন) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আয়োজিত জনসভায় অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, “আমরা এই ব্যবস্থা (সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র চর্চার নিষেধাজ্ঞা আরোপ) মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত এদেশে গীত হইবেই।” উল্লেখ্য যে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিব ছাত্র জনতা কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
শেখ মুজিব মনে প্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যেন তার রক্তমজ্জায় মিশে ছিল। তাই পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়েও তিনি চীনে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা না করে সেদিন বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই বক্তৃতা শুধু বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ, ভালবাসা আর শ্রদ্ধার সাক্ষ্যই বহন করেনি তখন থেকেই তার হৃদয়ে লালিত ও বিকশিত হতে থাকে এক স্বাধীন বাংলাদেশের ছবি । ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বার্ষিকীতে তিনি তার হৃদয়ের সেই লালিত, বিকশিত অনুভূতিতে প্রকাশ করেন এবং বলেন, এ অঞ্চলের (পূর্ববঙ্গের) নাম হবে বাংলাদেশ। শুধু এটুকুই না, তার দু’বছর পর তিনি এক ঘরোয়া পরিবেশে এই আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে, দেশটা যদি কোন দিন স্বাধীন হয়, তবে কবি গুরুর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
#ভাষাআন্দোলন
#Bangabandhu
#SheikhMujib
#languagemovement
#বঙ্গবন্ধু