মঙ্গল গ্রহে প্রাণী থাকার কথা কি কুরআনে বলা আছে?
……………………………………………………………………………….
মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সন্ধানে নাসার রোবট পাঠানের ছবি ও নিউজ দেখে এখনি ইসলামী সাইটগুলো বলা শুরু করেছে পৃথিবীর বাইরে প্রাণ থাকার ইঙ্গিত কুরআনে ১৪০০ বছর আগেই করা হয়েছে! বড়ই অদ্ভূত এই ইসলাম! হিন্দি চুল চল্লিশ দিনের মধ্যে কাটতে এখানে সোজাসুজি বলা থাকে কিন্তু ভীনগ্রহের প্রাণী থাকার কথা নাকি ‘ইঙ্গিত’ করে বলা আছে! আমরা এখন দেখব সেই ইঙ্গিতের ধাপ্পাবাজী এবং কুরআনে পৃথিবী ও মহাকাশ সম্পর্কে কি বলা আছে।
মানুষ যখন চাঁদে গিয়েছিলো তখন কোন মুসলমানই সেটা স্বীকার করেনি। চাঁদ হচ্ছে পবিত্র। তাকে ঘিরেই ইসলামের দিবস নির্ধারিত হয়। সেখানে কি করে মানুষের পা পড়বে? কিন্তু বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তিতে তা বিরোধীতা করার মত যোগ্যতা মাদ্রাসা পড়ুয়া আলেমদের নেই। এই অযোগ্যতা ঢাকার জন্যই পর্দায় অবর্তীণ হোন হারুন ইয়াহিয়া এবং জাকির নায়েকের মত ইংরেজি জানা জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামী স্কলাররা। নাসা চাঁদে মানুষ পাঠায়নি হলিউডে শুটিং করে সেই ভিডিও দেখিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে তারা এই ধাপ্পাবাজী করেছে। তখন বামপন্থিদের কাছে এটা ছিলো রীতিমত গরম প্রচার। তাদের এই প্রচারের ভিত্তি ছিলো আমেরিকান একজন সাংবাদিক বিল কেসিং লিখিত বই ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকাস থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল।’। এই বইতে তিনি কিছু কুযুক্তি তুলে ধরে চাঁদে মানুষ যাবার কথা নাকচ করে দেন। বলাই বাহুল্য তার বিজ্ঞান না জানাই এর কারণ ছিলো। কিন্তু তার কথা আমেরিকার ৫ শতাংশ মানুষকে ঠিকই চাঁদের অভিযান ভুয়া এটা বিশ্বাস করাতে পেরেছিলো। কিন্তু আমেরিকার বাইরে মুসলিম বিশ্বে এবং কমিউনিস্ট মহলে এটি সাড়া ফেলেছিলো ব্যাপক। নাসা বিল কেসিংয়ের প্রতিটি যুক্তি বৈজ্ঞানিকভাবে খন্ডন করেছিলো সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই। যাই হোক, নাসার চন্দ্র অভিযান নিয়ে এখন আর পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের কোন সন্দেহ নেই। এমনকি মুসলিম বিশ্বও এখন চন্দ্র অভিযানকে স্বীকার করে নিয়েছে। বিজ্ঞানের এই যুগে মহাকাশ অভিযানকে আর কিছু দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না এটা বুঝতে পেরে অভিযানগুলোকে গ্রহণ করে আগেভাগে অভিযানের বিষয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোতে যে আগেই বলে দেয়া হয়েছে- এই ফন্দি ধর্মজীবীরা ঠিক করে নিয়েছে। ভ্যাটিকান যেমন আজকাল বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুর সঙ্গে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ দেখতে পায়, তেমনি ভারতের বেদান্ত গবেষকরাও বিজ্ঞানের কথা ঋষিদের কিতাবে আগেই আবিস্কার করে ফেলে। আর মুসলমানরা তো সর্বদাই বলে সব বিজ্ঞান গবেষণাগারে একটা করে কুরআন রাখা আছে। সেই কুরআন দেখেই তারা সব আবিষ্কার করে ফেলে।
এবার শুরু থেকে বলা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে যদি প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে সেটা কুরআনের ১৪০০ বছর আগেই বলা ছিলো প্রমাণ হয়ে যাবে! চন্দ্র অভিযানের মত রিস্ক আর তারা নিতে চাচ্ছে না আর কি! যাই হোক, কুরআনে এলিয়েন থাকার পক্ষে যে আয়াতটিকে প্রমাণ হিসেবে প্রচার হচ্ছে সেটি হচ্ছে- “তিনি আল্লাহ, যিনি সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন সৃষ্টি করেছেন; এগুলির মাঝে তাঁর নির্দেশ অবতীর্ণ হয় যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞানতো সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে” (সুরা তালাক্ব, আয়াত: ১২)।
এখন বলা হচ্ছে সাত আসমান ও অনুরূপ যমিন বলতে আসলে সাতটি গ্রহের কথাই কুরআন বুঝিয়েছে যেখানে আল্লাহর সৃষ্টিসমূহ সৃজিত হয়েছে। তাজ্জব কথা! ১৪০০ বছর আগে নবী মুহাম্মদের সঙ্গে যারা কুরআন শিখেছেন তারা কেউ এই আয়াত মানে পৃথিবীর মত সাতটি গ্রহের কথা জানেননি অথচ এখনকার মুমিনরা এটাকে ‘সাতটি গ্রহ’ বানিয়ে দিলো? মঙ্গল গ্রহের কথা কিন্তু প্রাচীন ব্যাবিলয়রা জানত। তারা এটাকে তাদের যুদ্ধের দেবতা মনে করত যার নাম দিয়েছিলো ‘Nergal’। কিন্তু রোমানদের দেয়া নামটাই টিকে গিয়েছিলো। তারাও এই গ্রহের নাম তাদের যুদ্ধের দেবতা ‘Mars’ এর নামে নামকরণ করেছিলো যা আজো সেই নামেই থেকে গেছে। একইভাবে রোমান ও গ্রীকদের কৃষি দেবতা ‘saturnus’ নামানুসারে ‘শনি গ্রহ’। বুধ রোমান দেবতা ‘mercury’ নামকরণ করা হয়েছে যিনি রোমান পুরাণ অনুযায়ী জুপিটার বা বৃহস্পতি দেবতার পুত্র। প্রাচীনকালে ব্যবসায়ীরা এই গ্রহকে সন্মান করে প্রার্থনা করত কারণ এই দেবতা ছিলো দ্রুতগতির। এছাড়া বৃহস্পতি রোমানদের সবচেয়ে বড় দেবতা জুপিটারের নামানুসারে রাখা হয়েছিলো। অর্থ্যাত ইসলামের জন্মের হাজার বছর আগে এই পৃখিবীর মানুষ গ্রহগুলোকে চিনত এবং নামকরণ করেছিলো। তার মানে পৃথিবী সম্পর্কেও তাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ছিলো। কাজেই কুরআনে পরিস্কার করে লেখা ‘সাতটি আকাশ’ ও ‘সাতটি যমিন (ভূখন্ড)’ বলার পরও কেন সেটাকে আমাদের সাতটি গ্রহ মনে করতে হবে? বগলের চুল কাটার কথা সরাসরি বলতে পারলে মঙ্গল গ্রহে প্রাণী আছে বলা গেলো না কেন? কেনই কুরআন লেখার দেড় হাজার বছর পর নাসা যখন মঙ্গলে রোবট পাঠালো তখন মনে হলো এখানে গ্রহের কথা বলা আছে? আপনারা কি মুহাম্মদের চাইতে বেশি কুরআন বুঝেন?
দেখুন মুহাম্মদের কাছে কুরআন শিক্ষা নেয়া সাহাবীরা কথিত আয়াতের কি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ১৪০০ বছর আগে। সুরা তালাক্ব এর ১২ নম্বর আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, সাঈদ ইবনু জুবায়ের বলেন, এক ব্যক্তি ইবন আববাস (রাঃ)-কাছে এসে তিনবার উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তিনি কোন জবাব দিলেন না। মানুষজন তাঁর কাছ থেকে চলে গেলে লোকটি আবার বলল, কেন আপনি আমার জবাব দিচ্ছেন না? ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, আমি যদি তোমাকে সে-ব্যাখ্যা বলি তাহ’লে তুমি কুফরী করবে না, এমন আশঙ্কা থেকে তুমি কি মুক্ত? লোকটি বলল, আমাকে সে-ব্যাখ্যা বলুন। ইবনু আববাস বললেন, আসমান যমীনের নিচে আর যমীন আসমানের উপরে। এভাবে একটা আরেকটার সাথে গুটানো আছে। আসমান-যমীন সমূহের মাঝে এভাবে ঘুরে, যেমন নাটাই তার সূতা নিয়ে ঘুরে। (কিতাবুল আযামাহ, ২/৬৪৩; তাফসীরুর রাগেব ১/৫২৫)। যুহায়লীসহ অনেকে মনে করেন, সাতটি যমীন রয়েছে, তবে একটির সাথে আরেকটি মিলে আছে, এমনটি নয় (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/১৭৫; তাসীরুল মুনীর ২৮/২৯৯)। শায়খ আত্বিয়া সালেম বলেন, যমীন সাতটি একটির সাথে আরেকটি মিলে আছে। এদের মধ্যে কোন দূরত্ব নেই (শরহ বুলূগুল মারাম ৬/২১৩)।
এই তাফসির পড়ে কি কারো মনে হচ্ছে এখানে সৌরজগতের গ্রহগুলোর কথা বলা হচ্ছে? কিংবা মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন দূরের কোন গ্রহের কথা বলা হচ্ছে? উল্টো কিছু পাগলের প্রলাপ ছাড়া এগুলো আর কিছুই না। বড়জোর রূপকথার ‘পাতালপুরী’ টাইপ কিছু ধারনা করা যেতে পারে। কুরআন মতে পৃথিবীর সৃষ্টির পর আল্লাহ মহাশূন্য যা আকাশ সৃষ্টি করেছেন। সেই আকাশে তিনি তারকা দিয়ে আলোকসজ্জা করেছেন! অথচ এইসব কথিত আলোকসজ্জা মানে নক্ষত্রগুলোর বয়েস বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন পৃথিবীর জন্মের মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের বেশি! কুরআনে পৃথিবীকে আগে সৃষ্টি করার বিষয়ে একাধিক আয়াত আছে। যেমন: “বলো তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে আর তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রভু। তিনি ভূপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চার দিনে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, যাঞ্চাকারীদের জন্য সমভাবে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অতঃপর তিনি ওটাকে এবং পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে।” (আল কুরআন, ফুসসিলাত (হা-মিম সিজদাহ) ৪১ : ৯-১১)।
এইসব আজগুবি সৃষ্টিতত্ত্ব যে বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারের সামনে হাস্যকর তা আজকের যুগের একটা বাচ্চাও ধরতে পারবে। আকাশ বলতে যে কিছু নেই, এটা যে মাথার উপর কোন কঠিন পদার্থের চালা নয় এটা কুরআন লেখককের জানা ছিলো না। বিগ ব্যাংয়ের পর ক্রমশ যখন পদার্থগুলো ঘূর্ণনের ফলে জমাট বাধতে লাগল তখন গ্রহ নক্ষত্রগেুলোর সৃষ্টি। এগুলো সৃষ্টি হতে মহাবিশ্বে একেক জায়গায় একেক সময় লেগেছে। পৃথিবী মহাবিশ্বের অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র একটি গ্রহ যার জন্মের আগে অনেক নক্ষত্র জন্মে আবার নিভেও গেছে! এত বড় বড় অসংগতি থাকার পর এখন ভীনগ্রহে এলিয়েন থাকার দলিল আগেভাগে তৈরি করে রেখেছে!
#সুষুপ্ত_পাঠক