মধুভাতে মধু নেই, তবে মধুর

Uncategorized
মধুভাতে মধু নেই, তবে মধুর
মধুভাত চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় খাবার। মধুভাত নাম থেকে বোঝা যাচ্ছে এটা একধরনের ভাত, যদিও মধুর সাথে এ ভাতের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্ভবত মিষ্টিধুর স্বাদের জন্যেই এ ভাতের নাম মধুভাত রাখা হয়েছে। 
মধুভাত জিনিসটি সম্পূর্ণত কিরাত বা মঙ্গোলয়েড সংস্কৃতিজাত। মঙ্গোলয়েড বা কিরাত নৃগোষ্ঠীর এক ডজনেরও বেশি ধরনের জনগোষ্ঠী বাস করে চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে, যেমন– চাকমা, মারমা বা মগ, ত্রিপুরা, ম্রো, চাক্, বম্, তঞ্চইঙ্গা, কুকি বা মিজো ইত্যাদি। এ ছাড়া, মায়ানমারের আরাকান রাজ্য হল চট্টগ্রামের নিকটতম প্রতিবেশী। অনতিদূর অতীতেও চট্টগ্রামে মগী বা আরাকানী শাসন এবং মগী সন প্রচলিত ছিল। চট্টগ্রাম নামটির উদ্ভবের পেছনেও মগ বা আরাকানী শব্দ রয়েছে বলে অনেক পণ্ডিতজন মনে করেন। 
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনে এই মঙ্গোলয়েড সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। তাদের পরিধেয়, খাদ্যাভ্যাস, যানবাহন, কথ্যভাষা প্রভৃতি সবকিছুতেই এ সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে, যা চট্টগ্রামী বাঙালিদের বাংলার অন্যান্য অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালিদের থেকে কিছুটা আলাদা বা বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেমন– কিরাত নৃগোষ্ঠীর মতো চট্টগ্রামী বাঙালিরাও আতপ চালের ভাত খায়, যদিও বাংলার অন্যান্য জেলার লোক প্রধানত সেদ্ধচালের ভাত খেয়ে থাকে। চট্টগ্রামে মগী সংস্কৃতির প্রভাবজাত আরেক জনপ্রিয় বাঙালি খাদ্য হল শুঁটকি। একইভাবে মধুভাতও চট্টগ্রামের নিকটতম এই প্রতিবেশী সংস্কৃতি থেকেই পাওয়া, যদিও মগী বা আরাকানি ভাষায় মধুভাতকে কী বলে, আমার জানা নেই।  
মধুভাত তৈরির পদ্ধতিটি আপাতভাবে অতি সরল মনে হলেও আসলে ততটা নয়। এর জন্যে একটু সময়সাপেক্ষ প্রস্তুতি এবং প্রকরণেরও দরকার হয়। প্রথমত এর জন্যে কিছু ধান বস্তা বা ঝুড়িতে করে পুরো একদিন বা ২৪ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর জল থেকে তুলে আরো দু-তিনদিন রাখার পর ধানগুলোতে যখন ভালো করে কল বা গ্যাজ বা অঙ্কুর গজাবে, তখন সেগুলোকে রোদে শুকিয়ে কলে বা ঢেঁকিতে ভেনে চাল করে নিতে হয়। চালগুলো দেখতে হয় আধভাঙা এবং একটু হলদেটে ধরনের। এ চালকে বলা হয় (ধানের) ‘জালার চাল’ বা ‘মধুভাতের চাল’। অসলে দই পাতার সময় যেমন মাওয়া দিয়ে জোড়ন দিতে হয়, তেমনি মধুভাত রান্নার সময় এই জালার চালবাটা দিয়ে জোড়ন দেয়া হয়, যা সাধারণ আতপ চালের ভাতকে মধুভাত করে তোলে। চট্টগ্রামের গেরস্থ ঘরে এ চাল তাৎক্ষণিকভাবে মধুভাত তৈরির পাশাপাশি ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্যে সংরক্ষণ করা হয়। 
মধুভাত তৈরির জন্যে আতপ চালের ভাত (নতুন চাল হলে সবচেয়ে ভালো হয়) রান্না করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ভাতটা যেন একটু নরম গোছের হয়। তারপর জালার চাল খুব মিহি করে বেটে গুঁড়ো করে সেই ভাতের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চামচ দিয়ে ভালো করে সমস্ত ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সেইসঙ্গে মেশাতে হবে নিজেদের স্বাদমতো চিনি আর নুন। তারপর হাঁড়ির মুখ চাপা দিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে। সকালে দেখা যাবে, হাঁড়িভরা ভাত গলে গিয়ে সাদা ধবধবে থকথকে পায়েসের মতো দেখতে মধুভাত তৈরি হয়ে গেছে। এখন শুধু এর ওপর তাজা নারকেল কোরা ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশনের অপেক্ষা। অধিক খাদ্যরসিকরা একটু বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, যখন এই মধুভাত সামান্য টকে গিয়ে এক অসাধারণ অম্লমধুর স্বাদের সৃষ্টি হয়। 
মধুভাত তৈরির সময়  জালার চাল আর সাধারণ চালের অনুপাতটা ঠিক রাখতে হবে। অনুপাতটা ভুল হয়ে গেলে ভাত কিন্তু ভালো করে গলবে না, শুকনো শুকনো বা দলা দলা হয়ে যাবে। মোটামুটিভাবে অনুপাতটা হল– সাধারণ চালের ভাত : জালার চালের গুঁড়ো :: ৪ : ১। অর্থাৎ ধরুন, এক কেজি চালের ভাতে আড়াইশ গ্রাম জালার চালের গুঁড়ো মেশাতে হবে। 
মধুভাত খাওয়ার জন্যে শীতের হিমেল সকালই সুপ্রশস্ত, তবে গরম কালেও মন্দ নয়। অনেকে দুধ দিয়েও মধুভাত খেয়ে থাকে, যদিও আমি দুধ ছাড়াই বেশি পছন্দ করি। 
বেলা ১২:৫৮ 
২৩।১১।২০২১ 
চট্টগ্রাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *