আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করার পরেও প্রায় দেড় লাখ বছর আগের মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে নিজেদের খুব একটা আলাদা করে তুলতে পারেনি। হ্যাঁ, আগুনের বদৌলতে তাদের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছুদক্ষতা তারা এখন সিংহকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না, শীতের রাতে কৃত্রিম উত্তাপ উপভোগ করে, এমনকি ছোটোখাটো একটা জঙ্গল জ্বালিয়ে দিতেও পারে। তার পরও, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ আর আইবেরীয় উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল অঞ্চল) তখন সব মিলিয়ে মোট ১০ লাখ মানুষও ছিল না। বিশাল বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সেটা ছিল নিতান্ত নগণ্য।
এ সময়টাতে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি পৃথিবীতে টিকে থাকলেও তাদের সম্পূর্ণ উপস্থিত ছিল কেবল আফ্রিকার এক কোণে। বিবর্তনের ঠিক কোন পর্যায় থেকে এই প্রাণীটিকে হোমো সেপিয়েন্স বলে ডাকা যায়, সেটা ঠিকঠাক নির্ণয় করা যায় না। তবে এখন থেকে প্রায় দেড় লাখ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার মানুষগুলো দেখতে যে ঠিক আমাদের মতোই ছিল এ ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একমত। তখনকার একটা মানুষের মৃতদেহ যদি ঘটনাচক্রে আজকের কোনো মর্গে চলে আসে, সে মৃতদেহকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে কেউ বলতে পারবে না সেটা এখনকার না দেড় লাখ বছর আগের। সেই দেড় লাখ বছর আগেই মানুষের দাঁত ও চোয়াল ছোটো হয়ে এসেছে, আর মস্তিষ্ক হয়েছে অনেক বড়ো। এর পুরো কৃতিত্ব হলো আগুনের।
বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারেও একমত যে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে কিছুসেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে পৌঁছে। সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরেশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ইউরেশিয়া হলো ইউরোপ এবং এশিয়ার একত্রিত এলাকা।
সেপিয়েন্স যখন মধ্যপ্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশিরভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারাল মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সংকর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সঙ্গে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সঙ্গে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সংকর প্রজননের ফলাফল।
উদাহরণস্বরূপ, যখন সেপিয়েন্স মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পৌঁছল তখন তাদের দেখা হলো নিয়ান্ডার্থালদের সঙ্গে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, নিয়ান্ডার্থালরা পেশিবহুল ছিল। তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনেক ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। তাদের মস্তিষ্কের আকারও সেপিয়েন্সদের চেয়ে বড়ো ছিল। তারা অস্ত্রের ব্যবহার জানত, আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং সব রকম শিকারে তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী ছিল। পুরাতাত্ত্বিকেরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অনেকদিন বেঁচে থাকা নিয়ান্ডার্থাল মানুষের দেহাবশেষ পেয়েছেন, যা থেকে ধারণা করা যায় তারা অসুস্থ ও দুর্বলদের যত্ন নিত। এখনকার বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রে নিয়ান্ডার্থালদেরকে অসভ্য, নির্বোধ পশুতুল্য গুহামানবরূপে চিত্রিত করা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক প্রমাণ মোটেই তা বলে না।
সংকর প্রজনন তত্ত্ব বলে, যখন সেপিয়েন্স নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায়, মানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালেরা মিলে সন্তান উৎপাদন শুরু করল। এভাবে দুটি প্রজাতি মিলে মিশে একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো। সত্যি যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা বিশুদ্ধ সেপিয়েন্স নয়, সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালের মিশ্রণ। একইভাবে সংকর প্রজনন তত্ত্ব অনুযায়ী যখন সেপিয়েন্সরা ৬০ হাজার বছর আগে চীনে পৌঁছায়, তখন সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। তারা স্থানীয় হোমো ইরেক্টাসদের সঙ্গে মেশে এবং সন্তান উৎপাদন শুরু করে। ফলে চীন ও পূর্ব এশিয়ার লোকজনও খাঁটি সেপিয়েন্স নয়, স্থানীয় হোমো ইরেক্টাস এবং নবাগত সেপিয়েন্সদের সংমিশ্রণ।
মোটামুটি এই হলো সংকর প্রজনন তত্ত্ব বা Interbreeding Theory। এই তত্ত্বের বিপরীতে আরেকটা তত্ত্ব আছে, যেটার নাম প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বা Replacement Theory। এই প্রতিস্থাপন তত্ত্ব পুরো বিপরীত ধরনের একটি গল্প বলে আমাদের। এ গল্প অসহিষ্ণুতার, এ গল্প ঘৃণার এবং সম্ভবত গণহত্যারও।
প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্সের সঙ্গে অন্য কোনো প্রজাতির মানুষের, নিয়ান্ডার্থাল বা ইরেক্টাস কারো সঙ্গে কোনো প্রকার যৌন সম্বন্ধ সংঘটিত হয়নি। সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডার্থালদের দেহের গঠন ভিন্ন ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা যৌনমিলন প্রক্রিয়া ছিল। এমনকি তাদের শরীরের গন্ধও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অন্য কোনো প্রজাতির সঙ্গে যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি তাদের খুব কমই আগ্রহ ছিল। যদি কোনো নিয়ান্ডার্থাল রোমিও সেপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেমে পড়েও এবং তাদের যদি কোনো সন্তানও হয়- প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী এ শিশুটি হবে বন্ধ্যা (Infertile)। ঠিক যেভাবে গাধা ও ঘোড়া মিলিত হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু প্রজনন-অক্ষম খচ্চরেরই জন্ম দিতে পারে। একইভাবে নিয়ান্ডার্থাল রোমিও এবং সেপিয়েন্স জুলিয়েট কেবল প্রজনন-অক্ষম সংকর প্রজাতিরই সৃষ্টি করতে পারে।
সুতরাং, প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডার্থাল এই দুই জনসমষ্টি স্পষ্টভাবে আলাদা হয়েই রইল। তারপর যখন নিয়ান্ডার্থালরা মারা গেলো, কিংবা খুন হয়ে গেল, তাদের জিন (Gene)-গুলোও শেষ হয়ে গেল। নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিবর্তনও থেমে গেল তখনই।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেপিয়েন্স অন্য প্রজাতিগুলোর সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক স্থাপন না করেই তাদের স্থান সম্পূর্ণ দখল করে নিল। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায় যে, আজকের পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ সেই ৭০ হাজার বছর আগেকার পূর্ব আফ্রিকার মানুষেরই বংশধর, আমরা সবাই নির্ভেজাল হোমো সেপিয়েন্স।
বিবর্তন প্রক্রিয়াটি এত ধীরগতির যে এর জন্য ৭০ হাজার বছর আসলে খুবই কম সময়। প্রতিস্থাপন তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তাহলে এখনকার সব মানুষের সব জিন ঘুরে ফিরে কমবেশি একই রকম হবে। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে জিনগত পার্থক্য হবে খুবই সামান্য। আবার সংকর প্রজনন তত্ত্ব সত্য হলে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের জিনে বড়ো ধরনের পার্থক্য দেখা যাবে, যে পার্থক্যের সূচনা হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর পক্ষে জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে আর এই তত্ত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে অধিক উপযোগী (আর বিজ্ঞানীরাও আধুনিক মানুষের জিনের ভিন্নতা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ তৈরি করতে চাননি)। কিন্তু ২০১০ সালে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। চার বছর চেষ্টার পর নিয়ান্ডার্থাল জিনোম (Genome) প্রকাশের ফলে তা আর চাপা থাকেনি। জিন-বিশেষজ্ঞরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ডিএনএর সঙ্গে সমকালীন মানুষের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেল তা চমকে দেওয়ার মতো।
সমীক্ষায় দেখা গেল, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বর্তমান মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ মৈালিক ডিএনএ হলো নিয়ান্ডারর্থাল ডিএনএ। মিলের পরিমাণটা খুব বেশি না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কয়েক মাস পর আরো বড়ো একটি চমক আসে। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত জীবাশ্মে রূপান্তরিত মানুষের আঙুলের ডিএনএ মানচিত্র ক্সতরি করা হয়। ফলাফলে দেখা গেল, আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সঙ্গে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ প্রায় ৬ শতাংশ মিলে যায়।
তবে এখনই কোনো উপসংহার না টানাই উচিত, কারণ এ গবেষণা এখনো শেষ হয়নি; শেষ পর্যন্ত এই ফলাফল নাও টিকতে পারে। যদি এই ফলাফলগুলোই টিকে থাকে, তাহলে সংকর প্রজনন তত্ত্বের সমর্থকদের দাবি আরেকটুজোরালো হবে। তাই বলে প্রতিস্থাপন তত্ত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আজকের মানুষের জিনে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা মানুষের জিনের পরিমাণ খুবই অল্প, তা থেকে বোঝা যায় সেপিয়েন্সদের সঙ্গে অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর ‘মিশে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেপিয়েন্সদের সঙ্গে মানুষের অন্যান্য প্রজাতির জিনের পার্থক্য এত বেশি ছিল না যাতে তাদের সন্তান জন্মদান ব্যাহত হয়, কিন্তু তার পরেও এমন ঘটনা ছিল বিরল।

তাহলে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভার মধ্যকার সম্পর্ক কীভাবে বুঝব? এটা পরিষ্কার যে এরা ঘোড়া ও গাধার মতো সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি নয়, আবার এরা বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতো একই প্রজাতির আলাদা সদস্যও ছিল না। জীববিদ্যায় পার্থক্যগুলো সব সময় সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট হয় না, এর মধ্যে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার স্যাপারও থাকে। একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত ঘোড়া এবং গাধা একসময় একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন ধরনের সদস্যই ছিল, ঠিক বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতোই। তাহলে নিশ্চয়ই এমন একটা সময় ছিল যখন এই দুই ধরনের প্রাণীর আন্তঃপ্রজননে প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম নিতে পারত। তারপর তাদের জিনের কোনো একটা পরিবর্তনের (Mutation) কারণে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল, আর এই দুটি প্রাণীকে বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে গেল দুটি ভিন্ন পথে।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা ঠিক এমন একটা পরিবর্তনের মুখে পড়েছিল। তারা পুরোপুরি না হলেও প্রায় আলাদা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছিল। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব, ততদিনে সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা প্রজাতির সদস্যদের থেকে শুধু শারীরিক বা জিনগত দিক দিয়েই নয় বরং সামাজিক কার্যকলাপ ও চিন্তাচেতনার দিকে থেকেও অনেকটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিরল ঘটনা হলেও, তখনো সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডার্থালের মিলনে প্রজননক্ষম সন্তান জন্মদান সম্ভব ছিল। ফলে দুই প্রজাতির মানুষ একসঙ্গে মিশে গেল না ঠিকই, কিন্তু কিছু নিয়ান্ডার্থালের খুব সামান্য পরিমাণ জিন সেপিয়েন্সের দেহে সফলভাবে জায়গা করে নিল। এটা চিন্তা করা একই সঙ্গে অস্বস্তিকর এবং রোমাঞ্চকরও যে হোমো সেপিয়েন্স কোনো এক সময়ে অন্য একটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং সন্তানেরও জন্ম দিয়েছে।
নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভা মানুষ না হয় সেপিয়েন্সদের সঙ্গে মিশে গেল না, কিন্তু তারা হারিয়ে গেল কেন? একটা সম্ভাবনা হলো সেপিয়েন্সরাই তাদের বিলুপ্ত করে দিয়েছে। ধরা যাক নিয়ান্ডার্থালদের কয়েক হাজার বছরের আবাস বলকান উপত্যকায় একদিন একদল সেপিয়েন্স এসে পৌঁছাল। তারা ওখানে গিয়েই খাদ্যের জন্য হরিণ শিকার আর গাছের ফলমূল সংগ্রহ করতে লাগল। এগুলোই ছিল নিয়ান্ডার্থালদের প্রধান খাবার। সেপিয়েন্সরা শিকার ও সংগ্রহে অনেক বেশি দক্ষ ছিল, কারণ তাদের প্রযুক্তি ছিল উন্নত আর সামাজিক বন্ধনও ছিল দৃঢ়। ফলে তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হতে থাকল। অন্যদিকে নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করা এবং বেঁচে থাকা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ল। তাদের মৃত্যুহার বেড়ে গেল, আস্তে আস্তে তারা সংখ্যায় কমতে কমতে বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গেল। কে জানে, নিয়ান্ডার্থালদের শেষ কয়েকজন হয়তো সেপিয়েন্সদের দলেই মিশে গিয়েছিল।
আবার এমনও হতে পারে, যখন সেপিয়েন্স আর নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে খাদ্য নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো, তখন এক দলের মানুষ অন্য দলের মানুষকে হত্যা করতে শুরু করল। সহিষ্ণুতা জিনিসটা সেপিয়েন্সদের মধ্যে বরাবরই কম। আজকের দিনেও গায়ের রং, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের পার্থক্যের কারণে যারা অনায়াসে নিজ প্রজাতির অন্য দলের ওপর খড়্গহস্ত হয়, তারা কি ভিন্ন প্রজাতির মানুষের জন্য এর চেয়ে বেশি সহনশীলতা দেখাবে? কাজেই এমনটা হতেই পারে যে, নিয়ান্ডার্থালদের সঙ্গে সেপিয়েন্সদের দ্বন্দ্বের ফলেই ঘটে ইতিহাসের প্রথম গোষ্ঠীগত গণহত্যা (Ethnic-cleansing)।
বিলুপ্তি যেভাবেই ঘটুক, নিয়ান্ডার্থাল এবং অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলো ‘কী হতো যদি’ নামে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে গেছে আমাদের সামনে। কী হতো যদি নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষেরাও সেপিয়েন্সদের সঙ্গে বাস করত আজকের পৃথিবীতে? কেমন হতো ভিন্ন প্রজাতির মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেই সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো? কীভাবে গড়ে উঠত তাদের ধর্মবিশ্বাস? ধর্মগ্রন্থগুলো কি নিয়ান্ডার্থালদেরও আদম ও ইভের বংশধর বলে স্বীকৃতি দিত? যিশুখ্রিষ্ট কি ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন? কোরআনে বর্ণিত জান্নাতে কি প্রজাতিনির্বিশেষে সব পুণ্যবান মানুষই স্থান পেতেন? রোমান সেনাবাহিনী কিংবা চীনের বিশাল রাজতন্ত্রে কি নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির কোনো কর্মচারীকে দেখা যেত? আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কি ‘সব প্রজাতির মানুষকেই সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে’- এ কথাটাকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হতো? কার্ল মার্কস কি সব প্রজাতির মানুষের জন্যই প্রচার করতেন সাম্যবাদ?
বিগত ১০ হাজার বছর ধরে এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিজেদেরকে পৃথিবীর একমাত্র মানবপ্রজাতি বলে ভেবে আসছে। তাদের এই ধারণা এতই বদ্ধমূল যে তারা এ ব্যাপারে কোনো রকম ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। মানুষের অন্যান্য প্রজাতির উপস্থিতিকে অস্বীকার করে মানুষ খুব সহজে নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব এবং অন্য সব রকম প্রাণী থেকে আলাদা ভাবতে পারে। চার্লস ডারউইন যখন বললেন, মানুষ আর দশটা প্রাণীর মতোই আরেকটি প্রাণী, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো হয়নি। আজকের দিনেও সে অবস্থা তেমন পালটায়নি। নিয়ান্ডার্থালরা যদি আজও টিকে থাকত, তাহলেও কি আমরা নিজেদেরকে সমগ্র প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে দেখতাম? সম্ভবত এটাই আমাদের পূর্বসূরিদের হাতে নিয়ান্ডার্থালদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ। তাদের সঙ্গে আমাদের মিল এত বেশি ছিল যা অস্বীকার করা কঠিন, আবার পার্থক্যও এত বেশি যে তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করতেও রাজি হয়নি সেপিয়েন্স।
সেপিয়েন্স দায়ী হোক বা না হোক, এটা দেখা গেছে যে তারা যখনই কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছেছে তখন সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সলোয়েনসিসের সর্বশেষ অস্তিত্ব নির্ণয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। তার কিছু পরেই হোমো ডেনিসোভা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়। নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। সর্বশেষ বিলুপ্ত হয় ফ্লোরেন্স দ্বীপের বামনাকৃতি মানুষের প্রজাতিটি, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। মানুষের এইসব প্রজাতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু তারা পৃথিবীতে রেখে গেছে তাদের দেহাবশেষ, পাথরের হাতিয়ার, আমাদের ডিএনএর মধ্যে কিছুজিন আর অনেক অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর রেখে গেছে আমাদের, মানুষের সর্বশেষ প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সকে।
সেপিয়েন্সদের এই বিপুল সাফল্যের রহস্য কী ছিল? কীভাবে মানুষ এত দ্রুত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল? কীভাবে এতরকম ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকল তারা? মানুষের অন্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্নই-বা করল কীভাবে? শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান, শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাই-বা কেন টিকতে পারল না সেপিয়েন্সদের আক্রমণের মুখে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলছে অন্তহীন বিতর্ক। এসব প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে ভাষা। ভাষার মতো অনন্যসাধারণ একটি ক্সবশিষ্ট্যই সেপিয়েন্সদের সাহায্য করেছে পৃথিবী জয় করতে।