মানুষ আগুনের ব্যবহার কীভাবে শিখেছিল?

Blog ইতিহাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভারত সচেতনতা

শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আগুনকে বশীভূত করা। আমরা এখনো সঠিকভাবে জানি না ঠিক কখন, কোথায় এবং কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আগুনকে আয়ত্তে এনেছে। প্রায় ৮ লাখ বছর আগে হয়তো কিছুকিছুমানুষ মাঝেমধ্যে আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু প্রায় ৩ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথাল আর হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষরা প্রায় প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আগুনের ব্যবহার করেছে। আগুন অন্ধকারে আলো দিয়েছে, ঠান্ডায় দিয়েছে উষ্ণতা। এমনকি  সিংহ ও ভালুকের মতো বিপজ্জনক প্রাণীদের ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্রও ছিল আগুন। এর কিছুদিন পরেই মানুষ তার আশপাশের বনজঙ্গল আগুন দিয়ে পোড়ানো শুরু করে। একবার বন পোড়া শেষ  হলে এবং আগুনের শিখা নিভে গেলে মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে  রাস্তা করে যেতে পারত। পাওয়া যেত আগুনে পোড়া অনেক প্রাণী যেগুলো অনায়াসে খাওয়া যেত। খাদ্যের সহজ সমাধান ছিল এই বন পোড়ানো। এটা ছিল আগুনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা।

কিন্তু মানুষকে রান্না করার ক্ষমতা দেওয়াটাই সম্ভবত আগুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। আমরা সাধারণত মানবজাতির ইতিহাসে রান্নাকে খুব বড়ো একটা পদক্ষেপ বা উন্নতি হিসেবে দেখি  না। অথচ ভেবে দেখলে, মানুষের ইতিহাসে রান্নার গুরুত্ব অপরিমেয়। রান্নার ফলে প্রকৃতির খাদ্যসম্ভারে নতুন নতুন খাবারের একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক  খাবারই ছিল, যেগুলো রান্না করা ছাড়া খেয়ে মানুষ হজম করতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ, গম, আলুর মতো খাবারগুলোই মানুষ রান্না করা ছাড়া খেতে পারত না। রান্না শেখার ফলে মানুষ অনেক  নতুন নতুন খাবার খাওয়া শুরু করল। আরেকটি সুবিধা হলো, রান্নার  ফলে জীবাণু ও পরজীবী প্রাণী মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের ক্ষেত্রে। অন্য আরো অনেক খাবারের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটে। ফলে  একবার যখন মানুষ রান্না করে খাবার খাওয়া শুরু করল, তখন থেকে অনেক রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তারা রক্ষা পেল। অন্যথায় নানা রকম জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করত, বসবাস করত, বংশবৃদ্ধি করত এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হতো। রান্না করার ফলে খাবার চিবানোর সময় কিংবা হজমের সময়টাও গেল কমে। আমাদের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জি গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা খাবার চিবোয়। তাদের পরিপাকতন্ত্র যাতে সহজে এ খাবার হজম করতে পারে, এর জন্যই তারা এমনটি করে। যারা আগুন দিয়ে খারার রান্না করে খায় তাদের জন্য সারা দিনে এক ঘণ্টাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট এবং খাবার হজম করার জন্যও তাদের অনেক কম শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রান্নার আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাবার হজমের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ফলে মানুষ ছোটো ছোটো দাঁত, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোয়াল এবং ছোটো খাদ্যনালি বা অন্ত্র (Intestine) দিয়েও অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারল। কিছুকিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে রান্না করে খাবার খাওয়া শুরুর সঙ্গে মানুষের অন্ত্র বা খাদ্যনালি ছোটো হওয়া এবং মস্তিষ্কের আকার  বৃদ্ধির সরাসরি যোগাযোগ আছে। যেহেতুদীর্ঘ অন্ত্র আর বড়োসড়ো মস্তিষ্কের দুটোরই অনেক বেশি বেশি শক্তির দরকার হতো চলার জন্য, তাই ও দুটো একসঙ্গে থাকাটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই, অন্ত্রের আকার ছোটো করে তার শক্তির ব্যবহার কমিয়ে রান্না  আমাদের আরো বড়ো মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীতে রূপান্তরিত  হওয়ার পথ সুগম করে দিল। আর তার ফলেই পরবর্তীকালে নিয়ান্ডার্থাল আর সেপিয়েন্সের উদ্ভব হলো।

মানুষ আগুনের ব্যবহার কীভাবে শিখেছিল?

আর এজন্যই বহু বিজ্ঞানী বলে থাকেন যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রথম যে বড়ো রকম পার্থক্য তৈরি হয়, সেটা আগুনের  কারণেই। আগুনকে আয়ত্তে এনেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে  নিজেদেরকে উঁচু পর্যায়ে উপনীত করেছে। প্রকৃতিতে প্রায় সমস্ত প্রাণীর শক্তিই মূলত তাদের শারীরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। আর শরীরের শক্তি নির্ভর করে তার পেশির শক্তিমত্তা কিংবা দাঁতের আকারের ওপর। প্রাণীটি যদি পাখি হয়, তাহলে ডানার আকৃতিও তার শক্তি জানান দেয়। যদিও এটা সত্য যে, নিজের শারীরিক শক্তির বাইরে কিছুকিছু প্রাণী প্রাকৃতিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু সেটার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ তাদের থাকে না। যেমন, ইগলেরা খুব সহজাতভাবেই চিহ্নিত করতে পারে কোনো জায়গায় গরম বাতাস বইছে কি না। তখন তারা সেখানে তাদের পাখা মেলে ধরে যাতে গরম বাতাস তাদের ঠেলে ওপরের দিকে তোলে। কিন্তু গরম বাতাসের এই স্তরগুলো কোথায় ও কখন তৈরি হবে-  ব্যাপারে ইগলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি যখন পাখা মেলে তারা এই গরম বাতাস ব্যবহার করে ওপরের দিকে ওঠে তখনো তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না এই বাতাসের ওপর। বাতাসের কতটুকুশক্তি তারা কাজে লাগতে পারবে, এটা নির্ভর করে তাদের ডানার বিস্তারের ওপর, তাদের ইচ্ছের ওপর নয়। মানুষ যখন আগুনকে আয়ত্তে আনতে শিখল, তখন তারা এমন একটি শক্তির নিয়ন্ত্রণ হাতে পেল, যার সম্ভাব্য ব্যবহার অফুরন্ত। ইগলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই গরম বাতাসের স্তরের ওপর। কিন্তু মানুষ যে-কোনো সময় চাইলেই আগুন জ্বালাতে পারে। এটা মানুষের  সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার চেয়ে বড়ো কথা হলো আগুনের শক্তি মানুষের শারীরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। একজন মাত্র মহিলা যে একটি বাতি বা চকমকি পাথর ব্যবহার করতে পারে, সে চাইলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো একটি বন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বস্তুত আগুনকে আয়ত্তে আনাটা ছিল মানুষের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করার  একটা পূর্বাভাস মাত্র। সে সময় আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল আজকের আণবিক বোমা বানানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *