মিডিয়ার চরিত্র সবখানেই এক – তসলিমা নাসরিন

Uncategorized

দিন রাত আমেরিকা ফ্রান্স ইতালি সৌদি আরব সুদান চীন ইরানে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করি, কটাক্ষ করি, প্রশংসার হলে প্রশংসা করি — ভারতের মানুষ  কিছুতে সায় দেন, কিছুতে দেন না। তাঁরাও বিশ্বের নানা দেশ সম্পর্কে অকুণ্ঠচিত্তে তাঁদের মত প্রকাশ করেন। কিন্তু যদি বলি ভারতে নারী নির্যাতন বেশি হচ্ছে, ধনী দরিদ্রের ফারাকটা কম করা উচিত,  ভারতীয় বিলিওনিয়ারদের উচিত চ্যারিটিতে  টাকা পয়সা আরও দান করা। ও মা, অমনি গালাগালি শুরু হয়ে যায়। যা বলার বাংলাদেশ নিয়ে বল, ভারতের ব্যাপার ভারতীয়রা দেখবে। তুই ভারতে জন্মাসনি, ভারত নিয়ে আর একটি কথা না। আরে বাবা আমি তো সৌদি আরবেও জন্মাইনি, ওদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যখন তীব্র তিরস্কার করি, তখন তো জোরে হাততালি দিস। মত প্রকাশ করতে হলে, বা কোনও কিছু নিয়ে উদবিগ্ন হতে হলে কি সেখানে জন্মাতে হয়?  পৃথিবীতে জন্মেছি এই কি যথেষ্ট নয় পৃথিবীর ভালো দেখলে সুখ পাবো, পৃথিবীর মন্দ দেখলে কষ্ট পাবো? যদি বলি ভারত মহান, যদি বলি ভারতের ধর্মটার একটা গুণ আছে, এই ধর্মকে  কেউ বিশ্বাস করলেও ঠিক, বিশ্বাস না করলেও ঠিক– অমনি হাজারো হাততালি, তখন কিন্তু কেউ বলে না তুই তো এ দেশে জন্মাসনি, এ দেশ নিয়ে বললি যে!

ভারত নিয়ে আমি লক্ষ্য করেছি আমি কম বলি। কম বলি কারণ ভারতীয়  দেশপ্রেমিকরা আমাকে বহুবার  হুমকি  দিয়েছেন আমি যেন মুখ বন্ধ রাখি, ভারত নিয়ে ভাবার জন্য  যাঁরা ভারতে জন্মেছেন  তাঁরা আছেন, ।কিন্তু তাঁরা কি সবাই সত্যিই আছেন? যদি সত্যিই থাকেন তাহলে তো একজনকেও আজ গৃহহীন হতে হয় না, একটি শিশুকেও ভিক্ষে করতে হয় না, একটি নারীকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয় না, একটি নিরপরাধকেও  নিহত হতে হয় না। এমনিতে জিহাদিদের গালি হুমকি  অহরহই খাচ্ছি, তার ওপর ভারতীয় দেশপ্রেমিকদের গালি হুমকি খেয়ে জীবনের ঝুঁকি আর দ্বিগুণ করতে চাই না। তাই  মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

কোনও দেশ  একাই  একশ নয়। সব দেশেরই অন্য দেশের সংগে বন্ধুত্ব রাখতে হয়।   শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নতি অর্থনীতি  সব কিছুর জন্য আমরা একে অপরকে অনুসরণ করি। একে অপরের উপদেশ পরামর্শ মানি।  দেশে বন্যা বা খরা হলে, দেশে মহামারি   বা দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বিপদে আপদে দুর্যোগে  দুঃসময়   বন্ধু-দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আজ উপমহাদেশের মানুষ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বাস করছে। অন্য দেশে বসে তাদের উপার্জনের যেটুকু দেশে পাঠায়, সেটিই তো দেশের আয়ের একটি
উল্লেখযোগ্য অংশ। তাছাড়া  ইউরোপ আমেরিকার  বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠন লক্ষ কোটি  টাকা ঢালছে উপমহাদেশে। ভারতবর্ষের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা তো ভারতবর্ষের বাইরের লোকেরাই করেছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরি থেকে ভারতবর্ষের ওপর লেখা আমেরিকান ইউরোপিয়ানদের বই পড়ে ভারতবর্ষকে যত জেনেছি, ভারতবর্ষে ষোলো  বছর বাস করে তার সামান্যও জানিনি।

মুশকিল হলো আমাদের অঞ্চলের অর্ধ শিক্ষিত জনগণ  নায়িকা গায়িকা ক্রিকেটার ফিল্মমেকার মিলিওনিয়ার  বিলিওনিয়ারদের   এত ভয়ংকর রকম জনপ্রিয় করে তোলে যে ওঁরা  হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে  নিজেদের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ,  সমাজ বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, শিল্প সাহিত্য বিশেষজ্ঞ, এবং  বুদ্ধিজীবী বলে জ্ঞান করতে থাকেন। অথচ তলিয়ে দেখলে  দেখতে পাবো, ওঁরা ধর্ম কুসংস্কার অশিক্ষা কুশিক্ষা নিয়ে অর্ধ শিক্ষিত লোকদের মতো জীবন যাপন করেন। কেউ সাঁই বাবার পাদদেশে কোটি টাকা ঢেলে আসেন, তো কেউ তিরুপতি গিয়ে মাঙ্গলিক দোষ খন্ডন করেন,  কেউ আবার মাথা ন্যাড়া করে হজ্ব সেরে আসেন।

মিডিয়ার চরিত্র সবখানেই এক। অর্ধ শিক্ষিত লোকেরা যেটি খেতে চায়, তাদের সেটিই খাওয়াবার ব্যবস্থা করে। সত্যিকার শিক্ষিত লোকেরা     যা খেতে চায়, সেটি যদি খাওয়াতো, তাহলে বলতো, পৃথিবীর প্রত্যেকের অধিকার আছে পৃথিবীর প্রত্যেকটি জায়গার  প্রত্যেকটি  ঘটনা নিয়ে নিজের মত, সে মত যেমনই হোক,  প্রকাশ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *