যশোরের ইতিহাস বলতেই রাজা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস।

Uncategorized

রাজা প্রতাপাদিত্যের কথা মনে আছে !!!!
যশোরের ইতিহাস বলতেই রাজা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস। অখন্ড ভারতের ইতিহাসে  রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন অ্যায়রনম্যান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মহারাষ্ট্রের  শিবাজি জন্মের বহুপূর্বেই রাজা প্রতাপাদিত্য এই বঙ্গের বিখ্যাত রাজা ছিলেন।  এজন্য তাকে “বাংলার শিবাজি” বলা হয়৷
জন্ম:
গুহ বংশীয় কায়স্থ, মহারাজা বিক্রমাদিত্য ও রাজা বসন্ত রায় যশোর রাজ্যের  কর্ণধার ও স্রষ্টা। ১৫৬০ সালে (মতান্তরে ১৫৬১ সালে) শ্রীহরি  বিক্রমাদিত্যর ঔরসে বসু কন্যার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা  হয় প্রতাপ গোপীনাথ। এই প্রতাপই বিশ্ববিশ্রুত বঙ্গেশ্বর মহারাজা  প্রতাপাদিত্য। যুবরাজ অবস্থায় তিনি “প্রতাপাদিত্য” নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
রাজা প্রতাপাদিত্য  ছিলেন বার- ভূইয়াদের অন্যতম। নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিন ২৪ পরগণা, যশোর,  কুষ্টিয়া, বরিশাল সুন্দরবন পর্যন্ত প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিলো।  তিনি আমৃত্যু বিদেশাগত মুঘল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন নিজ  মাতৃভূমি রক্ষায়।
রাজাভিষেক:
মহারাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর রাজ্য দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।  প্রতাপ ও বসন্ত রায়ের মধ্যে জমিদারির সম্পত্তি বিভক্ত হইল। প্রতাপ  জমিদারির দশ আনা অংশ এবং বসন্ত রায় জমিদারির ছয় আনা অংশ পেলেন। বসন্ত রায় এ  অসম বন্টন আপোষেই মেনে নেন এবং স্বীয় পুত্রদের ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন না  তোলার জন্য নির্দেশ দেন। রাজ্য বিভাজনের পরও বসন্ত রায় অনেক দিন রাজ্যের  ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।
প্রতাপ রাজ্যের অধীশ্বর হবার পর রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেন। ১৫৮৩  সালে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর নগরের ৮/১০ মাইল দক্ষিণে যমুনা  নদী ও ইছামতী নদীর সংগম স্থলে সুন্দরবন ঘেষে ধুমঘাট বা ঈশ্বরীপুর নামক স্থানে এক নতুন  নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। তথায় প্রতাপাদিত্যের রাজাভিষেক সম্পন্ন হয়। ধুমঘাটের  ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে বাংলাদেশের তীরকাটি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত।
প্রতাপের প্রতাপ বিস্তার:
বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্য সিংহাসনে আহরণ করেই সৈন্যবল  বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। সুচতুর প্রতাপ প্রথম থেকেই মোঘলদের সাথে যুদ্ধে  লিপ্ত হন। প্রতাপাদিত্য পর পর দুবার মোঘল বাহিনীকে পরাজিত করে । বিদেশী মগ, মুঘল,  পর্তুগীজ এবং পাঠানেরা রাজা প্রতাপের তলোয়ারের নিকট বারবার পরাস্ত হয়েছে। প্রতাপ আরাকান রাজকে পরাজিত করে তার কাছথেকে সন্দীপ নামক দ্বীপ জয় করেন।
প্রতাপাদিত্য রাজ্য  পরিচালনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৬০০ খ্রিঃ প্রতাপের ক্ষমতা ও খ্যাতি  সমগ্র ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। কবি ভারত চন্দ্র তাই লিখেছিলেন-
-“যশোর নগর ধাম প্রতাপ আদিত্য নাম মহারাজা বঙ্গজ কায়স্ত নাহি মানে পাতশায়,  কেহ নাহি আটে তায়ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থবরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর  বায়ান্ন হাজার যার পল্লীষোড়শ হলকা হাতি অযুত তুরঙ্গ সাতিযুদ্ধকালে সেনাপতি  কালী।”
প্রতাপের ১ম পরাজয় ও মৃত্যু:
প্রতাপাদিত্য মোঘল শাসনাধীন সপ্তগ্রাম  বন্দর লুট করে ধন সঞ্চয় করতে অগ্রসর হলেন। সপ্তগ্রামের ফৌজদার  প্রতাপাদিত্যের অতর্কিত আক্রমণ রোধ করতে পারলেন না। ফলে সপ্তগ্রামের সমুদয়  ধন সম্পদ প্রতাপাদিত্যের কুক্ষিগত হল।।
এই সময় আগ্রার দরবারে নানারকম  অশান্তি বিরাজ করছিল। বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর শাহজাদা সেলিম নুরুদ্দীন  মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এইবার জাহাঙ্গীর  দরবারে প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলো। এই সময়ে বসন্ত  রায়ের পুত্র কচু রায়ও সমগ্র কাহিনী বাদশাহের গোচরীভূত করল। সমুদয় অভিযোগ  শুনে জাহাঙ্গীর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে পাঠালেন প্রতাপাদিত্যকে দমনের জন্য।  মানসিংহ বাংলায় এসে সসৈন্য যশোর রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন এবং  কপোতাক্ষ নদের তীরে শিবির স্থাপন করে থাকলেন। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলার  বর্ষার সম্পর্কে মোঘল সেনাপতির কোনো ধারণা ছিলোনা। একদিকে বর্ষা ও মহারাজা  প্রতাপের নৌসেনায় আক্রমণে মোঘল সেনা বিপর্যস্ত ও ছত্র ভঙ্গ হয়েযায়,বাধ্যহয়ে  মানসিংহ পিছু হটতে বাধ্য হয়।
বর্ষার শেষে কিছুকাল পরে আন্দুলিয়া নিবাসী ভবানন্দ মজুমদার নামক এক জমিদার কে উৎকোচ প্রদান  করে,রাজা মানসিংহ তাকে নিজের পক্ষে আনে। তারই সাহায্যে মানসিংহ ধুমঘাট  আক্রমণ করতে সমর্থ হন।
প্রতাপ এবং তার পুত্র  উদয়াদিত্য ও অন্যান্য সেনানায়কগণ দীর্ঘদিন ধরে মোঘল বাহিনীর সাথে কতিপয়  খন্ড যুদ্ধ করলেন। অসীম সাহস ও অসামান্য রণচাতুর্য প্রদর্শন করে প্রতাপ শেষ  যুদ্ধে বন্দী হলেন। রাজা মানসিংহ বন্দী প্রতাপাদিত্যকে পিঞ্জরাবদ্ধ  অবস্থায় আগ্রায় প্রেরণ করলেন। পথিমধ্যে বানারসী ধামে উপস্থিত হওয়ার সাথে  সাথে প্রতাপাদিত্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতাপাদিত্যের কাহিনী নির্ভর একটি বিখ্যাত  ঐতিহাসিক “বৌঠাকুরানীর হাট” লেখেন। যা আজও বাঙ্গালির নিকট ব্যাপক সমাদৃত।
এই পরাক্রমশালী রাজা জীবনে একটিমাত্র যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন আর সেটাই তাঁর শেষ যুদ্ধ। ঐ যুদ্ধে  তাঁর স্বজাতির লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে বাংলার ইতিহাস, বাঙালির  ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম হত।
কিভাবে যাবেন:
প্রতাপাদিত্যের স্মৃতিবহুল স্থানটির নাম ঈশ্বরীপুর। এখানেই ছিল তার রাজধানী। বর্তমানে এলাকটি বংশীপুর নামে পরিচিত। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিমি গেলে শ্যামনগর। এই উপজেলা সদর থেকে সুন্দরবনের দিকে সোজা ৫ কিমি এগিয়ে গেলেই বংশীপুর বাজার। যার কিছু দূরেই সুন্দরবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *