যশোরের বন্দবিলায় ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন(১৯২৭-৩০)…….বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে……..
১৯২৭ সালে যখন গুজরাটের বরদলৈর কৃষকদের ঐতিহাসিক কর বন্ধ আন্দোলন সারা দেশে এক নতুন জাগরণ এনেছিল। প্রায় সমসাময়িককালে, বাংলাদেশের যশোরে, চিত্রা নদীর তীরে এক অখ্যাত গ্রাম বন্দবিলার সাধারণ মানুষ ইউনিয়ন বোর্ড গঠনের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ লড়াই-এর নজির সৃষ্টি করেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে ইতোপুর্বে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের প্রেরণায় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অনেকগুলো পল্লীসংস্কার সমিতি গড়ে ওঠে। ১৯২৫ সাল নাগাদ যশোরের স্বনামধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী বড় বিজয় রায়ের অনুগামী ছোট বিজয় কৃষ্ণ রায়-এর নেতৃত্বে বন্দবিলায় তার এক কেন্দ্র স্থাপিত হয়। অচিরেই নানা গঠনমুলক কাজে এই কেন্দ্রের সাফল্য সারা জেলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গরীব হিন্দু-মুসলমান চাষীদের মধ্যেও সমিতির কাজ বিপুল উদ্দীপনা জাগায়।
এই পটভুমিকায়, ১৯২৭ সালের শেষে বাংলা সরকার বন্দবিলায় Bengal Village Self Government Act.(B.V.S.G.Act,1919) অনুযায়ী এক ইউনিয়ন বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ও তার জন্য নির্বাচনের আদেশ দেন। কিন্তু এই আদেশের ফলে বন্দবিলার সাধারণ মানুষের মধ্যে এক তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।B.V.S.G. আইনের বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসন আমলের নেতৃত্বে কাঁথিতে যে ইউনিয়ন বোর্ড বয়কট আন্দোলন হয়েছিল, তার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তখনও উজ্জ্বল। তাঁরা বুঝতে পারেন যে নতুন ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপনের উদ্দেশ্য একদিকে যেমন গরীব প্রজাদের উপর নতুন কর চাপানো, অন্যদিকে এর মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষ ছড়িয়ে মুল জাতীয় আন্দোলনের স্রোতকে দুর্বল করা। বন্দবিলার নেতা ছোট বিজয় রায় কলকাতায় এসে সুভাষ চন্দ্র বসু, জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই অনুন্নত দারিদ্রপীড়িত, হিন্দু ও মুসলমান প্রধান অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা একতা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়েই সুভাষ চন্দ্র এই সংগ্রাম অনুমোদন করেন। বন্দবিলার মানুষ ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে জোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের অংশগ্রহনকারী নগেন গাঙ্গুলী মশাই বলেছেন যে প্রথমদিকে যশোর কংগ্রেস কমিটি এই আন্দোলনের বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। তারপর সুভাষ বাবুর হস্তক্ষেপের পরই সকলে একত্রিত হয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। উল্লেখ্য, যে যশোরের কৃষ্ণ বিনোদ রায় এবং তার যুবসংঘ এই আন্দোলনে সমর্থন করেন। এদিকে সরকারি আদেশ বলে ইউনিয়ন বোর্ডের ভোট আরম্ভ হলে গ্রামের বিত্তশালী মাতব্বরদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও দেখা গেল দিনের শেষে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৬টি। মানুষ জড়ো হয়েছে ভোট কেন্দ্রে নয়, কংগ্রেস অফিসে। ফলে ভোট বাতিল হয়। দ্বিতীয়বার ভোট নেয়া ঠিক হলো নিকটবর্তী খাজুরা গ্রামে। সরকারের তরফ থেকে আবেদন, হুমকি সবকিছুই দেখানো হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসহযোগে অটল থাকলেন। এবার একজনও ভোট দিতে এলেন না।
অভূতপূর্ব অসহযোগে ক্ষিপ্ত হয়ে সরকার এবার নয় জন মনোনীত সভ্য নিয়ে একটি সাজানো ইউনিয়ন বোর্ড চাপিয়ে তার মাধ্যমে নতুন কর ধার্য্য করলেন। আন্দোলন এবার নতুন পর্যায়ে উন্নীত হল। সাধারণ মানুষ কর বন্ধ আন্দোলনে সামিল হলেন।
এরপর প্রায় দুই বছর ধরে চলল লড়াই। ধার্যকর আদায়ের জন্য সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। কিন্তু সরকারি চাপ যত তীব্র হতে লাগল, আন্দোলনও তত দুর্বার হয়ে উঠল। সভা, সমাবেশ, মিছিল, বৈঠক, ম্যাজিক-লন্ঠন সহযোগে বক্তব্য, প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সভা ইত্যাদির ফলে বন্দবিলা সারা বাংলার নজর কেড়ে নিল। গণ অসন্তোষের ভয়ে বহু চৌকিদার, দফাদার, কর আদায়কারী কাজ ছেড়ে দিলেন। বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। বিলাতের পার্লামেন্টে এই আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হল।
১৯২৯ সালের অক্টোবর থেকে নতুন সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ বাহিনী বকেয়া কর আদায়ের নামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামবাসীদের তৈজস পত্রাদি, মাছ ধরার জাল, হালের বলদ ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী B.V.S.G Act-এর পরোয়ানায় ক্রোক করতে থাকে। বলা বাহুল্য আটক করা সম্পত্তির মুল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধার্য কর থেকে অনেক বেশি। তবু গ্রামবাসীরা এই প্ররোচনার মধ্যেও সম্পুর্ণ শান্তিপুর্ণ থাকেন। অবশ্য ক্রোক করা সম্পত্তি নিলামের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাও হাস্যকর ভাবে ব্যর্থ হয়। হাটে হাটে তারা নিলামের চেষ্টা করেন, কিন্তু যে মুহুর্তে জানাজানি হয় গবাদি পশু ও অন্যান্য দ্রব্য বন্দবিলার সত্যাগ্রহী কৃষকদের, তখনই হাটের মানুষ নিলাম বর্জন করেন।
তবুও ক্রোক ও দখল চলতে থাকে। অনেক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। বিজয় রায়(ছোট), বিনোদ বন্দোপাধ্যায়, মনমোহন ভট্রাচার্য্য প্রমুখ নেতাদের মিথ্যা মামলায় কারাদন্ড দেয়া হয়। এছাড়া দন্ডিত হন আরও অনেকে, যাঁদের মধ্যে ডাঃ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ভোলানাথ পালিত, সুধীর কুমার মুখোপাধ্যায়, বিজয় কুমার চট্রোপাধ্যায়, নিবারন মজুমদার, মহম্মদ হোসেন আলি প্রমুখেরা ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কারও কারও মতে এই সত্যাগ্রহের নেতা ছোট বিজয় রায় নাকি বার বার গ্রেফতার এড়িয়ে সমস্ত আন্দোলন পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই উপলক্ষ্যে স্থানীয় বিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ করে দেয়া হয়। শহরের যে সব পত্র-পত্রিকা বন্দবিলা আ্ন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাত, তারাও নানা ভাবে নিগৃহীত হয়। নানা প্রচারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষ ছড়ানো হয়, তবুও আন্দোলনকে দমন করা যায় না। তখন ভেদনীতি অনুসরণ করেই ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসন আইন এমনভাবে সংশোধন করেন যে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের জেলাবোর্ড, ইউনিয়ন বোর্ড প্রভৃতির নির্বাচনে জেতার সম্ভবনা কমে যায়। মুসলমান ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অবশ্য সরকারের উদ্দেশ্য অসৎ থাকলেও, এইভাবে গণতন্ত্রের প্রসার যে ঘটেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তৎকালীন যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান কৃষক দরদী সৈয়দ নওসের আলী এই দৃষ্টিভঙ্গির সক্রিয় সমর্থক ছিলেন বলে কংগ্রেস নেতারা তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দালাল এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী বলে নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বন্দবিলার বীরত্বপুর্ণ সত্যাগ্রহকে অভিনন্দিত করলেও এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার জন্য কখনই কোন উদ্যোগ গ্রহন করেননি। যে মুল অর্থনৈতিক কারণ-বিরাট কর বৃদ্ধির আশঙ্কা, এই আন্দোলনের গণভিত্তি ছিল সেই করও যখন খুব সামান্যই বাড়ানো হল, তখন গ্রামের গরীব মানুষেররা এই আন্দোলন সম্বন্ধে ধীরে ধীরে নিস্পৃহা হয়ে পড়েন। এই সব কারণে ১৯৩০ সালের মার্চ মাস নাগাদ বন্দবিলার ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে যায়। এদিকে তখন গান্ধীজী ডাক দিয়েছেন আইন আমান্য আন্দোলনের। জাতীয় সংগ্রামের এই মুল ধারার সঙ্গে বন্দবিলার আন্দোলনও ধীরে ধীরে মিশে যায়।
ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের নায়ক স্বনামধন্য ছোট বিজয় রায় ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর স্বগ্রামেরই দেহত্যাগ করেন। দেশ বিভাগের পরে বহু অনুরোধ উপরোধেও তিনি তাঁর জন্মভুমি ত্যাগ করেননি। বিজয় বাবু ১৯৩২ ও ১৯৪২ -এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময়ও কারারুদ্ধ হন। শেষবার জেলে থাকার সময় তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হন।