# **যশোরের যে রেলপথ হারিয়ে গেছে….**
**===================**
১৯১০ সালে যশোর থেকে চূড়ামনকাঠি, মিঠাপুকুরিয়া, শিবনগর, বিষয়খালী হয়ে ঝিনাইদহ পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটার ন্যারোগেজ রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম শুররু হয়। শেষ হয় ১৯১৩ সালে। কে এম ডি অ্যান্ড কোম্পানি নামক এক কন্সট্রাকশন কোম্পানি এই রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর নির্মাণের জন্য ব্যয় তৎকালীন প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা। এজন্য যশোর জেলা বোর্ডের কাছ থেকে ভর্তুকিও পেয়েছিল জে জে আর কোম্পানি। ১৯১৩ সালের ১ অক্টোবর যশোর থেকে ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে এই রেলপথের উদ্বোধন করা হয়।
আসলে বাংলায় রেলপথ নির্মাণের জন্য কতগুলো যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেল কোম্পানি গঠিত হয়েছিল তার কোনো ইয়াত্তা নেই। এই ক্ষুদ্র রেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে যশোর-ঝিনাইদাহ রেলওয়ে (জে. জে. আর.) কোম্পানি ছিল অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো দেশীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি আজন্ম লাভের মুখ দেখতে পারেনি।
কোটচাঁদপুরে চিনি শিল্প গড়ে উঠলে শিবনগরকে জংশন করে ১২ কিলোমিটারের এক লাইন কোটচাঁদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। শিবনগর কালীগঞ্জ থেকে ১ কিলোমিটার পশ্চিমে। সেখানে ছিল জংশন। (আর শিবনগরের অবস্থান বারোবাজারের দক্ষিণে।) জার্মানি থেকে ৪টি ন্যারোগেজ লোকোমোটিভ নিয়ে আসা হয়। নির্মাণের সময় থেকেই এই রেলপথের ব্যবসায়িক সফলতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তাই কোম্পানিটি কম খরচে ন্যারোগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৯২৪ সালে কোম্পানিটি ব্রিটিশ কোম্পানি ম্যাকলিউড লাইট রেলওয়ের সাথে একীভূত হয়।
যশোর-ঝিনাইদহ রেলপথ নির্মাণের পর থেকেই লোকসানের মুখে পড়ে কোম্পানিটি। ১৯৩১-৩২ অর্থবছরে হিসেব করে দেখা যায় প্রথম বেশ কয়েক বছর লাভের মুখ দেখলেও পরের বছরগুলোতে লোকসান গুনতে হয়। এদিকে যশোর জেলা বোর্ড ভর্তুকি দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। ফলে অব্যস্থাপনা এবং লোকসানের কারণে জর্জরিত হয়ে পড়ে কোম্পানিটি।
এই পরিস্থিতিতে ১ এপ্রিল ১৯৩৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। পরে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হলেও ১৯৩৬ সালে গড়ে ওঠে বাস সিন্ডিকেট। রেললাইনের পাশ দিয়ে বাস চলাচল শুরু হয়। বাস মালিকেরা যাত্রী ধরতে নানা উপহারের পাশাপাশি বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিতেন। এভাবে কয়েকবছর যাবৎ ট্রেনের সাথে বাসের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা চলে। অবশেষে বাস মালিকদের কূটকৌশলের কাছে হেরে যায় রেলওয়ে। রেলপথ থেকে তুলে নেওয়া হয় ট্রেনগুলো। বিলুপ্ত হয়ে যায় জে জে আর কোম্পানি। এরপর ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার রেলপথ তুলে ফেলে এবং রেলপথের উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করে, যা আজকে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক হিসেবে পরিচিত।
বাংলার রেল ইতিহাস অনেক বিস্তৃত ও বিচিত্র। রেল কোম্পানিগুলো কোথাও নির্মাণ করেছে ব্রডগেজ, কোথাও মিটারগেজ। আবার কিছু ক্ষেত্রে নির্মাণ করেছে ন্যারোগেজ। কিন্তু এই ভিন্ন ভিন্ন রেলপথ নির্মাণের কী উদ্দেশ্য ছিল? আসলে ব্রিটিশ আমলে কোম্পানিগগুলোর রেলপথ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িক স্বার্থ। সেজন্য আঞ্চলিক গুরুত্ব বিবেচনায় নির্ধারণ করত কেমন রেলপথ নির্মিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে লাভের আশা কম থাকত সেখানে কম খরচে ন্যারোগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হত। আবার বাণিজ্যিক গুরুত্ব বেশি থাকলে নির্মাণ করত ব্রডগেজ রেলপথ। তবে বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য ব্রিটিশ রেল কোম্পানিগুলোর লোকসানের ঘটনা খুবই বিরল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত রেলপথ নির্মাণের বদৌলতে এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ চলে গেছে লন্ডনে। এদেশের মানুষের রক্ত পানি করা কষ্টে উপার্জিত সম্পদে পকেট ভরত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের। উঁচু উঁচু দালান আর ঝলমলে শহর গড়ে উঠত ব্রিটেনে।