যোগ বা ইয়োগা : আধ্যাত্ম দর্শন থেকে প্রায়ােগিক দর্শন

Blog যোগ-ব্যায়াম সাস্থ্য স্বাস্থ্য

হিন্দুশাস্ত্রীয় নীতিগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতার জ্ঞানযােগে উল্লেখ রয়েছে, ঈশ্বর ভক্তের চোখে সাকার, জ্ঞানীর চোখে নিরাকার। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে এই ইয়ােগা বা পতঞ্জলির যােগশাস্ত্রে পরমচেতনাময় ঈশ্বরের যে রূপকল্প আঁকা হয়েছে তা নিরাকার এবং মহাবিশ্বপ্রকতির সাথে মিশে থাকা এক পরমচেতনাগত সত্তায়। এতেই বুঝা যায় এই যােগসাধনা মুক্তচিন্তাকে জ্ঞানযােগেরই অংশ। এ ঈশ্বর কথা বলতে জানা আশীর্বাদ বা অভিশাপ প্রদানােদ্যোগী কোন আকারসম্পন্ন সুদর্শন বা ভয়ঙ্করদেহী ঈশ্বর নন। এবং আরেকটু খেয়াল করলেই বুঝা যাবে যে। এখানে ঈশ্বরসংশ্লিষ্ট কোন অলৌকিকতার নামগন্ধও নেই। যা আছে তা হলাে মানবিক চেতনারই অনন্ত। বিস্তারকৃত এক মহাচৈতন্যময় সত্তার প্রকাশ, যা মহাবিশ্বপ্রকৃতির রূপক ধরেই এসেছে। অর্থাৎ এ দর্শনের মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে এই জগতকেন্দ্রিকতা এবং আরেকটু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে জগৎরূপী এই জীবদেহকেন্দ্রিকতা। আর এখানেই রয়ে গেছে একটি সুপ্রাচীন আধ্যাত্মদর্শনের ব্যবহারিক গুরুত্ব বিবেচনায় ধীরে দেশ কাল পাত্র সংস্কৃতি নিরপেক্ষ একটি প্রায়ােগিক দর্শন হিসেবে ব্যবহার উপযােগী হয়ে ওঠার মূল চাবিকাঠি।

আধ্যাত্মবাদের পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে কোনাে না কোনাে ধর্মের সক্রিয় উপস্থিতি। আর যেকোন ধর্মেরই মূল ভিত্তি হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে এড়িয়ে সংশ্লিষ্ট ধর্মের কথিত উৎস বা নাভিতে পৌঁছানাে কখনােই কি সম্ভব? পালনীয় উপাচার বা রীতিনীতিগুলাের সাথে অনিবার্যভাবেই যে সব প্রচলিত মিথনির্ভরতার অলৌকিক আবশ্যকতা জড়িয়ে থাকে, তা সে সাকার বা নিরাকার উপাস্য যে ধর্মই হােক, স্রষ্টা নামের যে পরম সত্তাকে সর্বশেষে স্বীকার করে নেয়া হয়, বায়বীয় হলেও তার একটা স্বকল্পিত রূপ মনের মধ্যে তৈরি হয়েই যায়। সাকার উপাস্যদের প্রসঙ্গ এখানে বলা বাহুল্য। বুঝার সুবিধার্থে উদাহরণ হিসেবে যদি নিরাকার উপাস্য একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর প্রসঙ্গ আনি, তাহলে কি বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার হতে পারে? এ ধর্মবিশ্বাস মতে এই সৃষ্টিজগতের যিনি স্রষ্টা, তার কোন আকার নেই। অর্থাৎ তিনি নিরাকার। সমস্ত সৃষ্টির পেছনের এই উৎস হচ্ছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ। তার ইচ্ছার বাইরে কোন কিছু সংঘটিত হওয়া এ ধর্মবিশ্বাসমতে কিছুতেই সম্ভব নয়। এবং স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উপাসনা করার যেসব বিধি-বিধান নির্ধারিত, তার মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে নামাজ অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলেই বিবেচনা করা হয়। নির্ধারিত ও অলঙ্ঘনীয় প্রক্রিয়া হিসেবে একজন পালনকারীর নামাজ আদায়কালীন শারীরিক ও মানসিক স্থিরতা প্রাপ্তির যে চর্চাটা নিয়মিত চর্চিত হয়, এর যে একটা জাগতিক উপকারিতা রয়েছে তা একজন যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীর চোখেও অস্বীকার করা বােধ করি ঠিক হবে না। কিন্তু এ দৃশ্যমান চর্চাটা কিন্তু নামাজের মূল বিষয় নয়। এই নামাজ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত লক্ষ্যে সুনির্দিষ্টভাবে একজন আল্লাহর অলৌকিক অস্তিত্বের কাছে হৃদয়মন সপে দিয়ে পুরােপুরি আত্মসমর্পণের বিষয়টাই এখানেই মৌল। একনিষ্ঠ একজন নামাজির সুনির্দিষ্ট সুরা পাঠ বাধ্যতামূলক এবং এর বাইরে যাবার কোন উপায় তার নেই। অনবধানতার মধ্যেও যদি কোন ধরনের বিচ্যুতি ঘটে, তাহলেও তাকে নামাজ আদায় হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না। প্রকতপক্ষেই এখানে নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ভােগ করার প্রশ্নই উঠে না।

এবারে ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী কিন্তু উদার নৈতিক ব্যক্তিটি যদি নামাজের স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্রিয়াটায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর উপকারার্থে অনুরূপ শারীরিক কস করতে উদ্যোগী হন, তাতে কি তার কোন অভীষ্ট ফল লাভ সম্ভব? কিছুতেই সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। কেননা নামাজ যে কারণে নামাজ হয়ে ওঠে তা পেছনে রয়েছে কল্পিতভাবে একজন অবিকল্প আল্লাহকে বাধ্যগতভাবে শুধু স্বীকার করেই নয়, পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে তাঁর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণের ইচ্ছাশক্তির একাগ্রতার চর্চা। এর সাথে মনের যে যােগ রয়েছে, একজন অবিশ্বাসীর কাছে এ মনােযােগ থাকার প্রশ্নই আসে না। এবং তা অসম্ভবও। একইভাবে খ্রীষ্টধর্মে বিশ্বাসীদের ঈশ্বরপুত্র যীশুখ্রীষ্ট বা কুমারী মাতা মেরীর অলৌকিকতায় মিথলজিক্যাল বিশ্বাস বা অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রেও যার যার স্রষ্টার উপাসনার স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াগুলাের পেছনে সংশ্লিষ্ট ধর্মের প্রাসঙ্গিক বিশ্বাসগুলােই ওতপ্রােতভাবে জড়িত। অতএব দেহ-মনের সুস্থতার প্রায়ােগিক চর্চা হিসেবে নির্দিষ্ট উপাচারগুলাের নিজস্ব বিশ্বাসের গণ্ডির বাইরে আদৌ কোন ব্যবহারযােগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। ফলে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে অভিন্ন প্রয়ােগধর্মিতা এখানে অসম্ভব।

আবার কোনরূপ অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী বৌদ্ধ দর্শনের মূল সুর হচ্ছে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম। এ দর্শন অনুযায়ী পৃথিবীর সবকিছুই অনিত্য, দুঃখই সত্য, আর চিরস্থায়ী আত্মা বলে স্থির কিছু নেই। অদৃশ্য কোন কিছুর প্রতি, অলৌকিক কিছুতে তথাগত বুদ্ধ বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেননি। তার চিন্তার কেন্দ্র বিন্দুতে ঈশ্বর ছিল না, ছিল মানুষ ও মানুষের সমাজ। তবু এই ধর্মমতাবলম্বীদের উপাসনা পদ্ধতিতে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধই যখন উপাস্য দেবতা হিসেবে পূজিত হন, তখন তাও ব্যবহারযােগ্যতায় নিজস্ব বিশ্বাসের গণ্ডি অতিক্রম করার উপায় থাকে না। ফলে ইহলৌকিক মানবসত্তার দেহমনের সুস্থতার একান্ত চর্চামাধ্যম হিসেবে তথাকথিত অনুশাসনমূলক ধর্মীয় দর্শনগুলাের নিজস্ব বিশ্বাসের বাইরে যখন নমনীয় হয়ে ধর্ম বর্ণ সংস্কৃতি নির্বিশেষে সার্বিকভাবে কোন ব্যবহারযােগ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখনই বিস্ময়কর ব্যতিক্রম হিসেবে পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যােগচর্চার আধ্যাত্ম দর্শনে সেই নমনীয় ও উদারনৈতিক সর্বব্যাপকতা অনায়াসেই খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির উত্তরাধিকার ধারণ করেও পতঞ্জলির এই ইয়ােগা দর্শনে যে নমনীয় আধ্যাত্মিক রূপান্তরযােগ্যতা রয়েছে, তাতে করে যে কোন ধর্মের যে কোন সংস্কৃতির বা প্রকৃতই একজন অবিশ্বাসীরও নিজস্ব ধর্মমত, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নিজস্ব চর্চায় ধারণ করেও এই ইয়ােগা দর্শনের সাথে মিশে যেতে কোনরূপ স্ববিরােধী সমস্যায় পড়তে হয় না। আর এখানেই দেহমন সুস্থ রাখার সাধনপ্রক্রিয়া হিসেবে এই ইয়ােগা শাস্ত্রের অনন্যতা।

যোগ বা ইয়োগা : আধ্যাত্ম দর্শন থেকে প্রায়ােগিক দর্শন

পতঞ্জলির যােগশাস্ত্র যােগশাস্ত্র কোন ধর্মমত নয়। সুস্থ দেহ মনের একাগ্রতা প্রত্যাশী। চর্চা উপযোগী একটা ইহলৌকিক আধ্যাত্মদর্শন কেবল। এর প্রাথমিক ধাপের পাঁচটি অঙ্গের মরাল কোড বা আচরণবিধি এবং শুদ্ধাচার ও মনােবীক্ষণের কােন ধর্মমত বা দর্শনের কোথাও কোন বিরােধ নেই। বরং মৌল সহযোগী। পরবর্তী ধাপের অঙ্গগুলােতে যে আধ্যাত্মিক বীক্ষণ রয়েছে তাতে সে নিজ নিজ বিশ্বাস বা উপাস্য দেবতা বা স্রষ্টার কল্পরূপ প্রতিস্থাপন উন্মুক্ত স্বাধীনতা এই দর্শনকে যে আপেক্ষিক যােগ্যতা দান করেছে, তাতেই তা সর্বক্ষেত্রে অনায়াস গ্রহণীয় হতে পেরেছে। আর এর মনােদৈহিক স্বাস্থ্য রক্ষার অভূতপূর্ব ক্ষমতা এটাকে সর্বময় ব্যবহারযােগ্য করে তুলতে সক্ষম সয়ছে। এবং আরাে বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে, হাজার বছর পেরিয়ে এসেও সমকালীন বিজ্ঞানচেতনায় এর মনােদৈহিক চর্চার ব্যাখ্যা কী অভাবনীয় ইতিবাচক মর্যাদায় সংরক্ষিত হয়ে উঠেছে! আর এভাবেই একটা আধ্যাত্ম দর্শন চমৎকারভাবে প্রায়ােগিক যােগ্যতা অর্জন করে অত্যাবশ্যক গুরুত্ব নিয়ে দেশ কাল সময়ের গণ্ডি ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র!

এখানে একটা বিষয় আমাদের ভুলে যাওয়া চলে না যে, কোন আধ্যাত্ম দর্শন যখনই প্রায়ােগিক ও ব্যবহারিক দর্শন হিসেবে সংস্কৃতি ও বিশ্বাস নিরপেক্ষ গ্রহণযােগ্যতা পেতে শুরু করে, সাথে সাথে খুব যৌক্তিকভাবেই এর অন্তর্গত বিষয় ও লক্ষ্যেও একটা পরিবর্তনের ধারা অব্যহত প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে। এটাকেই যােজন-বিয়ােজনের খাপখাওয়ানাে পদ্ধতি বলে কিনা কে জানে। তবে মূল দর্শনের রিচ্যুয়াল ও স্পিরিচুয়াল টার্গেটের সাথে পরিবর্তিত দর্শনের প্রয়ােজনমুখীনতা আর এক বা অভিন্ন থাকে না। যা পতঞ্জলির ইয়ােগা শাস্ত্রের বর্তমান ব্যবহারিক দর্শনে কিছুটা লক্ষ্য করা গেলেও এর মৌলত্বে তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না। উদ্দেশ্য নির্ধারণে যেমন, পদ্ধতিগত চর্চার ক্ষেত্রেও তাই।

একজন নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসীর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্পিরিচুয়াল টার্গেট বা আধ্যাত্মিক লক্ষ্য তাঁর বিশ্বাসের চিহ্নিত প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে। ওখান থেকে টলে যাওয়া মানে তাঁর ধর্মবিশ্বাসেই পরিবর্তন ঘটে যাওয়া। এক্ষেত্রে ইয়ােগা তাকে সে বিশ্বাস থেকে টলায় না একটুও। বরং ইয়ােগা তাকে সহায়তা করে দেহমনের পরিপূর্ণ সুস্থতা ও শুদ্ধতা আনয়ন করে তাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য আরাে বেশি একাগ্র ও সমর্থ করে তুলতে। পাশাপাশি একজন অবিশ্বাসীর কাছেও ইয়ােগার গুরুত্ব একটুও হ্রাস পায় না বটেই, বরং মুক্তচিন্তার উদারমনস্কতার মধ্যে তাকে আরাে বেশি সচেতন করে তুলে মহাবিশ্বপ্রকৃতির ব্যাপ্তিকে তাঁর চিন্তনসত্তায় অধিকতর অর্থবহ করে তােলে। আর একান্তই সাধারণ একজন ব্যক্তির কাছেও ইয়ােগা উপস্থিত হয়ে যায় দৈনন্দিনতার বৈচিত্র্যহীন গডডালিকায় দুশ্চিন্তাময় অস্থিরতার মধ্যেও এমন সুস্থ শরীর ও মনের এক অভূতপূর্ব আস্বাদন নিয়ে তাকে সত্যিই এক অসাধারণ উপলব্ধির জলে স্নাত করতে প্রস্তুত। একটা চমৎকার সুস্থ দেহের চাইতে বড় কোন সম্পদ এই লৌকিক বিশ্বে আর থাকতে পারে!

আর এভাবে চলতে চলতে ইয়ােগা তার গভীর আধ্যাত্মিক গৃঢ়তা ধারণ করেও দেহমন চর্চার এমন এক অতিগুরুত্বপূর্ণ ইহলৌকিক চেহারা পেয়ে যায়। যে, তাকে যে কেউ যে কোনভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে কোন বেগ পেতে হয় না। যারা গভীর স্পিরিচু্যয়াল চর্চায় নিজেকে নিমগ্ন করবেন তাদের জন্য ইয়ােগা বিশ্ব উন্মুক্ত তাে আছেই। আর গড়পড়তা সাধারণ দেহধারী যারা তার বােঝা হয়ে উঠা বা উঠতে উদ্যত শরীরটাকে বাগে এনে সাধ্যের মধ্যে সম্ভাবনাগুলােকে চেখে দেখার গৃঢ় ইচ্ছা পােষণ করেন, এই প্রতিকূল সময়ে তাদের জন্যও ইয়ােগা চর্চা আরাে বেশি প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয় । এইসব প্রাসঙ্গিকতার মধ্যেই সমকালীন বিজ্ঞানদৃষ্টিও যখন এই ব্যবহারিক ইয়ােগার গুরুত্বকে একটুও খাটো না করে আবশ্যকতার ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ করে তােলে, আমাদের নির্ভর করার জায়গাটা তখন যে সত্যিই আরাে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!

আর বাসু, লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *