রাম জ্যেষ্ঠপুত্র এবং প্রচলিত রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মে তিনিই অযোধ্যার রাজা হবেন। কিন্তু না, রামকে রাজা হতে দেয়া যাবে না। ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে। কিন্তু রাম থাকতে এটা কিভাবে সম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করার পরিকল্পনা যিনি ডিজাইন করেছিলেন তিনি রাজসভাসদদের কেউ নন। তিনি রাজনীতির একদম বাইরের মানুষ। এমনকি সে সময়ের সমাজের এলিট কোনো ব্যক্তিও তিনি নন। তিনি রাজপুরির একজন বৃদ্ধা দাসী, নাম মন্থরা। ‘কুঁজী বুড়ি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদে সৃষ্ট বাংলা মহাকাব্যে কবি কৃত্তিবাস ওঝা মন্থরার রূপ বর্ণনায় বলছেন,
“তার পৃষ্ঠে কুঁজ যেন ভরন্ত ডাবরী।
কুটিল কুরূপা কুঁজী ক্রূরকর্ম্মকারী।।
দশরথ পেয়েছিল বিবাহে সে চড়ী।
রাম রাজা হন দেখি করে ধড়ফড়ি।।
আকৃতি প্রকৃতিতে কুৎসিতা দেখি তারে।
সর্ব্বনাশ করে কুঁজী থাকে যার ঘরে।।”
সেই কুঁজী সমকালীন রাজনীতির সবচেয়ে কঠিন তত্ত্বটি দিলেন, যে থিওরিতে রাম নির্বাসনে যাবেন এবং ভরত রাজা হবেন। ভরত মাতা কৈকেয়ীকে (রামের সৎ মা) তিনি বললেন,
“মন্ত্রণা করিয়া রামে পাঠাও কানন।
ভরতেরে রাজ্য দেহ যদি লয় মন।।”
“কুঁজী বলে, যুক্তি চাহ যুক্তি দিতে পারি।
হেন যুক্তি দিব যে ভরতে রাজা করি।।
………………………….
দুই বর মাগিহ রাজার বিদ্যমানে।।
এক বরে করাইবা রাজা ভরতেরে।
আর বরে পাঠাইবা অরণ্যে রামেরে।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ যদি রাম থাকে বনে।
পৃথিবী পূরাবে তুমি ভরতের ধনে।।”
রামায়নের ঐ ঘটনার ভালমন্দ বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। দাসী মন্থরাকে আইডিওলাইজ করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি কেবল বলব, স্কোপ থাকলে অতি সাধারণ মানুষও অনেক বড় কাজ করতে পারে – ভালও করতে পারে, মন্দও করতে পারে। মানুষ কোথায় জন্ম নিয়েছে, তিনি কোন বংশের, তিনি পুরুষ না নারী…… ইত্যাদির কোনোটাই মানুষের যোগ্যতার নিয়ামক নয়।
আশির দশকের শেষভাগে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সন্দেহ ছিল। তখন ক্ষমতায় ছিলেন এরশাদ এবং মাঠের রাজনীতিতে দুই বৃহৎ দল আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিএনপি’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ৯১’র নির্বাচনে যখন খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হলেন -তিনি প্রধানমন্ত্রী- তবুও মানুষকে বলতে শুনেছি, দেশ কি খালেদা চালায়? তিনি উপলক্ষ মাত্র। তাকে সামনে রেখে অন্যরা (পুরুষরা) দেশ চালাচ্ছে। ৯৬এ যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন তখনও এরকম কথা মানুষ বলেছে। এখন আর এরকম কথা কাউকে বলতে শুনিনা। এখন বরং শেখ হাসিনার একছত্র ক্ষমতা এবং তিনি ছাড়া যেন সরকারে আর কেউ নেই – এরকম সমালোচনাই বেশি শুনি। অর্থাৎ এই দুই নেত্রী প্রমাণ করেছেন, নারী হলে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না -একথা সঠিক নয়। মানুষে মানুষে মেধার তারতম্য আছে বৈকি। কিন্তু সেই মেধা ও যোগ্যতা মানুষের জাত, পাত, জন্ম, বংশ, নারী, পুরুষ, হিজড়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে না।
পুলক ঘটক