রিলিজিওন আর ধর্মের পার্থক্য কেমন হয়?

Uncategorized
রিলিজিওন আর ধর্মের পার্থক্য কেমন হয়?
এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম একেবারে ভিন্ন ধর্মের ধারণা নিয়ে আসে ইসলাম। বৌদ্ধ, তাওইজম, জৈন, ইত্যাদি ধর্ম সনাতন ধর্মের কাছাকাছি আদর্শের। কিন্তু ইসলাম প্রথম এ অঞ্চলে ‘রিলিজিওন’ এর ধারণা নিয়ে আসে। রিলিজিওনের বাংলা করা হয়েছে ধর্ম। কিন্তু রিলিজিওন আর ধর্ম এক বিষয় না! 
ধর্ম হল- মনেকরুন, মানুষ হয়ে আপনি প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। এটা কোন পুরষ্কারের লোভে বা শাস্তির ভয়ে না, এটাই আপনার ধর্ম, তথা আপনার বৈশিষ্ট্য।
রিলিজিওন হল- আপনি কোন অদৃশ্য বা দৃশ্য মহাশক্তিমান জাদুকরের উপাসনা করেন তার ভয়ে। কিংবা সেই মহাশক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। অথবা আপনাকে বলা হয়েছে, ‘তুমি এটা করলে ওটা পাবা’ – এই লোভের মায়াজালে আকৃষ্ট হয়ে তার উপাসনা করেন। 
ইসলাম প্রথমে অনেকগুলি নতুন ধারণা নিয়ে আসে, যেমন ধর্মান্তর। এছাড়াও আছে কাজ শুরুর আগে সূরা, খারাপ খবর শুনলে সূরা, সুসংবাদে সূরা, বিপদে পড়লে সূরা। এ অঞ্চলে এই বিষয়টা কখনই ছিল না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে উপাস্যের নাম নেয়া ঠিকই ছিল, তবে মাতৃভাষায়, নিজের মত করে, নিজের প্রাণ থেকে, সহজভাবে। 
ধর্ম আর রিলিজিওনের পার্থক্যটা এখানেই। আমার দাদু প্রায়ই আশীর্বাদ করার সময় বলেন ‘দীর্ঘজীবী হও’, আমার মা-বাবা জন্মদিনে আমার জন্য কামনা করেন ‘দীর্ঘজীবী হও’। এই কথাটা বলার জন্য কোন ‘আয়ুষ্মান্‌ ভব’ মুখস্ত করার দরকার পড়ে নি। কোন কাজ শুরু করার আগে যে যে যার যার উপাস্যের নাম নিয়ে মাতৃভাষায় সাহায্য কামনা করত। যারা একটু পড়াশোনা করেছে, তারা হয়তো বা সেই উপাস্যের প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করত। সেটাও মনে মনে। আশেপাশের সবার উপাস্য একই হলেও। ‘ধর্ম যার যার’ এই ধারণাটা অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে ছিল। কারণ অপরের কর্মের জন্য নিজের কর্মফল কখনোই নির্ভর করত না। 
খৃস্ট ধর্মেও ‘হে ঈশ্বর, হে খৃস্ট আমাকে রক্ষা কর, দয়া কর, সাহায্য কর, মঙ্গল ফল দাও’ ইত্যাদি আছে, ধর্মগ্রন্থটাও অনুবাদ করা মাতৃভাষায়। 
মঙ্গোলীয়দের মাঝে একটা প্রবাদ আছে, ‘যে মুহূর্তে তুমি তোমার ক্ষতি করার মানুষটার উপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করো, সেই মুহূর্তে তোমার পরাজয় ঘটে, কারণ তোমাতে আর তা’তে কোন পার্থক্য অবশিষ্ট থাকে না’। 
এই একই কথা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রেও খাটে অনেকটা। বলা যায় প্রতিযোগিতার ধরণ যদি একটাই হয়, তাহলে সব প্রতিযোগীই একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে, এতে সমস্যা কই? কিন্তু প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক না। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিপক্ষকে বিলুপ্ত করার ব্যাপার থাকে, প্রতিযোগিতায় তা থাকে না।
গ্রীক ও রোমান ধর্ম বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়েছে সামরিক শক্তি ছাড়াও আরেকটা কারণে। তারাও জাদুকরে বিশ্বাস রাখত। তবে তারা বহু জাদুকরে বিশ্বাস রাখত। সেই বহু জাদুকরের বিশ্বাস খুব সহজেই এক জাদুকর দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা গিয়েছে। কারণ ক্যামেরা, স্টপওয়াচ, রেডিও, এম্পিথ্রি প্লেয়ার, কবুতর, ঘড়ি ইত্যাদি আলাদা আলাদাভাবে বহন করার চেয়ে, রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে, একটা স্মার্টফোন রাখা বেশি সুবিধার। মধ্য প্রাচ্য থেকে পশ্চিমে সবই রিলিজিওন, প্রাচ্যে সবই ধর্ম।
আমাদের ধর্মে এখন বিসমিল্লাহ্‌র অনুরূপ কথা আছে, ইনালিল্লাহ্‌র অনুরূপ কথা আছে, আয়াতুল কুরসীও আসবে সামনে, আসবে ঈমান রক্ষাকারী কথাও। সেই সাথে অধিকাংশ হিন্দুর মনে আছে ইসলামের জন্য ঘৃণা। এই ঘৃণা হয়তো বা নির্যাতিত হবার কারণে, নতুবা আশেপাশের বাকি হিন্দুরা ঘৃণা করে দেখে, অর্থাৎ ঘৃণা করার জন্য ঘৃণা; জানেও না ঘৃণাটা কেন? অর্থাৎ আমরা এখন ইসলামের অনুরূপ একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চাই, একই সাথে ইসলামকে ঘৃণা করি; আমাদের পরাজয়টা এখানে। এটাই আমাদের ভণ্ডামী যে, আমরা ইসলামের রীতিনীতিতে মুগ্ধ, ইসলামের রীতিনীতি আমাদের আদর্শ মনে হয়, তবে সেটি স্বীকার করতে আগ্রহী না। 
সনাতন বৈদিক ধর্ম ছেড়ে আমরা আচরণে সেই আব্রাহামিক রিলিজিয়নকেই ফলো করে যাচ্ছি। সম্বোধন নমস্কার বললে মাথা নিচু হয়ে যায়, এতে কোনো ফল পাওয়া যায় না। এজন্য আমরা হরে কৃষ্ণ বলা শুরু করেছি। যাদের আরো বেশি ফলের লোভ লেগেছে তারা হরে কৃষ্ণ বাদ দিয়ে রাধা রাধা বলা শুরু করেছে। তবে সাধারণ কিছু মানুষ এসবের বাইরে। এরা ধর্মপ্রেমী। এরা জানেই না সনাতন ধর্মের সম্বোধন নমস্কার, অন্যকিছু নয়। এরা ধর্মকে ভালোবেসে অন্যজনকে দেখে সেটাকেই ফলো করে যাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেই আব্রাহামিক রিলিজিওন ফলো করে। গ্রুপে অনেকেই প্রশ্ন করেন ইসলাম ধর্মের মানুষ ওটা বলে তাহলে আমাদের ধর্মে কোনটা বলব। অর্থাৎ রিলিজিওন দিয়ে ধর্মকে জাস্টিফাই করা।  কেউ মাইকে আযান দেয় বলে আমাদেরকেও মাইক বাজিয়ে রাস্তায় কির্তন করতে হবে। অথচ সনাতন বৈদিক ধর্মে ধ্যান করে আধ্যাত্মিকার স্তরে যাওয়াই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য।  শান্ত, নির্জন স্থান বেছে নিয়ে শান্ত চিত্তে ঈশ্বরকে অনুভব করা, সন্ধ্যা উপাসনা করাই আমাদের ধর্ম ছিল। এখন সেটা হৈহুল্লুরে ঠেকেছে। কির্তন করা খারাপ কিছু নয়। প্রচুর মানুষের মেলবন্ধন করানো যায়। কিন্তু হিংসা থেকে সৃষ্ট কর্ম কখনোই ধর্মের সংজ্ঞায় আসতে পারে না। 
ধর্মের জগৎটা শান্তির, রিলিজিওনের জগৎটা রাজনীতির, ব্যবসায়ের, লড়াইয়ের।
রিলিজিওন আর ধর্মের লড়াইয়ে, ধর্মের অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে আমরা পরাজিত। আমরাও এখন রিলিজিওনের অনুসারী হয়ে যাচ্ছি। তবে মনে রাখবেন, ধর্ম শান্তি প্রদান করে আর রিলিজিওন সংঘর্ষ। 
#Collected

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *