লাল সালাম ‘স্যার’ এম এন লারমা

Uncategorized
লাল সালাম ‘স্যার’ এম এন লারমা
অন্তত এক যুগ আগের কথা। রাঙামাটিতে কোনো একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছে। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, অস্বস্তিটা প্রকাশ করে ফেললাম বন্ধু দীপায়ন খীসার কাছে, ‘আচ্ছা, একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি জীবনের একটা বড় সময় গেরিলা যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন, তাঁকে সবাই স্যার বলে ডাকে কেন?’
দীপায়ন বলল, ‘রাজনৈতিক নেতাকে নয়, সবাই একজন শিক্ষককে স্যার ডাকেন।’ দীপায়নের কাছ থেকেই জানলাম, শুধু সন্তু লারমা নন, তাঁর বড় ভাই জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাসহ তাঁদের সহযোদ্ধাদের অনেকেই শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। দীপায়নের ভাষায়, ‘পাহাড়ে রাজনীতির সূত্রপাত এই মাস্টার মশাইদের হাতে এবং এই মাস্টার মশাইদের প্রথমে রাজনীতিতে ঠেলে পাঠিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা, পরে আবার সামরিক শাসকদের পাহাড়ে সেটেলার সেটেলড করার নীতি। নয়তো এম এন লারমার মতো দু-চারজন ছাড়া বাকি মাস্টার মশাইরা পাহাড়ে শিক্ষার আলো বিতরণেই ব্যস্ত থাকতেন হয়তো।’ 
এম এন লারমার কর্মজীবন শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। পরে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এর মাত্র কয়েক বছর পর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনে আইন পেশা শুরু করেন।
বাংলাদেশের সংসদে আইনপ্রণেতা হিসেবে এম এন লারমার ভূমিকার কথা তো রাজনীতির ইতিহাস অল্পবিস্তর যাদের জানা আছে, তারা সবাই জানেন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে তিনি বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশে যে অন্য অনেক জাতি আছে, তাদের স্বীকৃতি আদায়ে লড়েছিলেন। ব্যর্থ হয়ে সংসদ ছাড়েন এবং পাহাড়িদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়েন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এম এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), যার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয় পাহাড়ের  জাতিগোষ্ঠীগুলো। 
পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান হাজার হাজার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠাতে শুরু করেন। বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরাও আছে, পাহাড়িদের সঙ্গে মিলেমিশেই তারা বসবাস করছিল। কিন্তু জিয়া যে সেটেলারদের রোপন করলেন, তাদের বেশির ভাগই জবরদখল শুরু করে দেয়। আরোপিত অভিবাসনে পাহাড়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট থেকে এম এন লারমা আত্মগোপনে চলে যান, গড়ে তোলেন জনসংহতির সামরিক শাখা—শান্তিবাহিনী। শুরু করেন গেরিলা লড়াই। পরে নিজ বাহিনীর কোন্দলেই তিনি ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর খুন হন নিজ দলের বিভেদপন্থীদের হাতে। আজ সেই ১০ নভেম্বরে ঢাকায় সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অডিটোরিয়ামে বিকেল ৩টায় তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, স্মরণসভা, প্রতিবাদী গান ও প্রদীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এমএন লারমা মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি এ আয়োজন করেছে। রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আয়োজন করেছে স্মরণসভা, কালো ব্যাজ ধারণ, অস্থায়ী শহীদ বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রদীপ প্রজ্বালন ও ফানুস ওড়ানোর কর্মসূচি। 
–লিখেছেন রাজীব নূর @ Rajib Noor

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *