প্রসঙ্গত, ১৯৫৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বহুবাজার কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী ও মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ও অবিভক্ত সিপিআই-এর প্রার্থী মহম্মদ ইসমাইলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কোনোক্রমে পোস্টাল ব্যালটের সাহায্যে ৫৪০ ভোটের ব্যবধানে ডঃ রায় জয়ী হন। নির্বাচনের সময়ে সিপিআই থেকে অভিযোগ জানানো হয় যে মুসলমানদের ভয় দেখানো ও হয়রান করা হচ্ছে। মহম্মদ ইসমাইলকে জেতানোর জন্য যে জলের মতো টাকা খরচ করে কম্যুনিস্টরা তা রাজনৈতিক মহলে এক বিহ্বলতা সৃষ্টি করে। এই বিপুল অর্থের উৎপত্তির সন্ধান করতে গিয়ে তৎকালীন কংগ্রেসের একাংশ পূৰ্ব পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতির মধ্যে তা খুঁজে পান।
এই প্রসঙ্গে ২১ শে মার্চ,, ১৯৫৭ – বিধানসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় অভিযোগ করেন, বহুবাজারে মহম্মদ ইসমাইলের সমর্থকরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়েছেন। ডঃ রায়ের কথায়, ‘জ্যোতি বসু অভিযোগ করেছেন যে, মুসলমানদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, এটা তিনি বলছেন না। . তিনি বলছেন নির্বাচনের পর মুসলমানদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যদি আমি নির্বাচনের আগেই এই উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহার করতে চাইতাম তাহলেই কেন আমি আমার প্রতিদ্বন্দীকে এত ভোট পেতে দেব?…..অন্যদিকে আমি মনে করি একজন ব্যাক্তি যে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে এই ধরণের কথা বলে তার সংঙ্গে, যে ব্যক্তি “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনি সংবলিত প্রচার করে তার অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমার মতে, এটা অনেক বেশি ক্ষতিকর। স্যার, আমি শুনেছি যে তারা বলছে: যদি মহম্মদ ইসমাইল জেতেন তাহলে তিনি স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্র্রী হবেন এবং যদি তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন তাহলে কলকাতা পাকিস্তানের মধ্যে চলে যাবে যেমন ভাবে কাশ্মীরের কিছু অংশ ইতিমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। আমি মনে করি এই ধরনের প্রচার জাতীয়তাবিরোধী, ভারতবিরোধী এবং পুলিশ যদি এই ধরনের প্র্রচার বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়ে থাকে তাহলে পুলিশকে প্রশংসা করা উচিত, নিন্দা নয়। যারা এই ধরনের প্রচার চালাচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে আমি রাজদ্রোহের মামলা আনব। এইটাই হল আমার পরিষ্কার ও স্বাভাবিক উত্তর।”……”এটা বলা ভুল যে আমি শুনেছি তারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিচ্ছে। আমি বলছি যে ১৪ তারিখ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমার বাড়ির সামনে দিয়ে একটি মিছিল যাচ্ছিল, সেই মিছিলে মহম্মদ ইসমাইল একটি গাড়ির মধ্যে ছিলেন এবং মিছিলের লোকেরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছেন।‘ (এই তথ্যসূত্র – “যত দূর মনে পড়ে” – শ্রী জ্যোতি বসু।)
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজদ্রোহের কোন মামলা দায়ের করা হয়নি ডঃ রায় দ্বারা। এবং এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তৎকালীন বিরোধী দলনেতা শ্রী জ্যোতি বসুর (অবিভক্ত সিপিআই) সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সৌহার্দমূলক সম্পর্ক ও সর্বোপরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহরুর অমোঘ প্রভাবই নাকি দায়ী।
প্রশ্ন ওঠে সহসা – মার্চ ২৬, ১৯৫০ সালে কমুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল পশ্চিবঙ্গের তৎকালীন কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার দ্বারা এবং যাকে এযাবৎকাল কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্র কর্তৃক তাঁদের ওপর অকথ্য নিপীড়ণের এক গাথা বলে মনে করেন তার অন্তনির্হিত চরিত্র কি? এই official prohibition কি নেহরুর সোৎসাহে হয়েছিল না অন্য কোন কারণ ছিল? এই প্রসঙ্গে তথ্যানুসন্ধান করতে দিয়ে দৃষ্টি পড়ে এটির ওপর – “পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অখুশি হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টদের মধ্যে অন্যতম শ্রী সরোজ চক্রবর্তী তাঁর “মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে” গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছেন। একটি কথোপকথন তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেননি, কিন্তু স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই লেখককে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘর ও তাঁর পি-এ’দের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি হালকা কাঠের দরজা। বিধানবাবু আমাদের ডাকবার জন্য সাধারণত বেল বাজাতেন না। তিনি হাঁক দিয়ে বলতেন, ‘ওহে।’ কিন্তু দরজাটা বন্ধ থাকলে ডা. রায়ের প্রথম ডাকটা আমরা ভালো করে শুনতে পেতাম না। ফলে উনি বকাবকি করতেন। এজন্য একটা কাঠের টুকরো দিয়ে আমরা দরজাটাকে একটু ফাঁক করে রাখতাম। কমিউনিস্ট পার্টিকে যে-আইনি ঘোষণা করার পর তিনচারদিন পর একদিন দুপুরে নেহেরুর ফোন এল ডা. রায়ের কাছে। ডা. রায় ফোন ধরেই আমাদের হাঁক দিয়ে বললেন, কিরণকে তাড়াতাড়ি ডাকো। আমি ছুটে গিয়ে কিরণবাবুকে বললাম, স্যার, ডা. রায় ডাকছেন, প্রধানমন্ত্রীর ফোন এসেছে। কিরণবাবুর মধ্যে কোন চঞ্চলতা নেই।
তিনি ধীরস্থিরভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢুকলেন। ডা. রায় সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কিরণবাবুর হাতে তুলে দিলেন। ওদিক থেকে জওহরলাল নেহেরু কি বলছেন জানি না। কিত্নু এদিক থেকে কিরণশঙ্কর রায় গম্ভীর গলায় ইংরেজিতে যে কথাগুলো বললেন, তার বাংলা তর্জমা এই দাঁড়ায় ‘কমিউনিস্টদের কাছে তোমার (নেহেরুর) সুনাম আছে, তাই তোমার সুনাম হারানোর ভয়ও আছে। ওদের (কমিউনিস্টদের) কাছে আমার সুনাম নেই, আমার সুনাম হারানোর ভয়ও নেই।’ এই কথাগুলো বলে কিরণবাবু রিসিভারটা ডা. রায়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। (” বঙ্গসংহার এবং” – শ্রী সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত – পৃষ্ঠা ১১১।)
নিঃসন্দেহে, নেহরুর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টি ভারতের কম্যুনিস্টদের ওপর চিরকালই ছিল যা তাঁদের ধীরে প্রতিষ্ঠিত করেছে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লেফট লিবারেলইজমের সমীকরণ যার মৌলিক বৈশিষ্ট দেখা যায়, যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু বিধানবাবুকে নেহরু কোন জাদু দিয়ে মোহিত করেছেন বারংবার? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। যে নেহরুর জন্য ডঃ রায় তাঁর ঘোষিত রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থাকেন, মাশুল সমীকরণ নীতির মতো পশ্চিমবঙ্গের জন্য অতীব ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া গলাধঃকরণ করেন তার উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরী, তার মূল কারণ সম্পর্কে জানা একান্তরূপেই প্রয়োজন। অবশ্যই, আরো অনুসন্ধানের প্রয়োজন।
প্রশ্ন আরও রয়ে যায়। যে বিধানচন্দ্র রায় টেলিফোনে উচ্চঃস্বরে নেহরুকে বলেছিলেন ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু গণহত্যা আটকাতে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে ( সূত্র -“মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে” – শ্রী সরোজ চক্রবর্তী), শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে ১৯৫২ সালে দিল্লিতে গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও শ্রী বিশ্বেশ্বরাইয়া আইয়ারের সাথে প্রায় হাতাহাতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন পূর্ব রেলের সদর দপ্তর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরানোর চক্রান্ত থামাতে (সূত্র – শ্রী দুর্গাদাস বসু) সেই একই ব্যক্তি প্রায় নীরব হয়ে গেলেন কেন? শ্যামাপ্রসাদের হত্যাপর্ব কি তাঁর অবচেতন মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল? ক্রমশ কংগ্রেস পার্টিতে Left liberalism বিরোধী দৃঢ় নেতৃত্বের অপসারণ যে সামান্য কোন ঘটনা নয় তা বুঝে গিয়েছিল রাজনৈতিক মহল যখন ১৯৬৯ সালে দিল্লির রামলীলা ময়দানে সংগঠন কংগ্রেসের ভাঙা অধিবেশনে শ্রী কামরাজ নাদার পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল সেনের চিঠিটি জনসমক্ষে পাঠ করেছিলেন – সেন ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন এবং সেই চিঠির বয়ান অনুযায়ী কম্যুনিস্ট ইন্দিরা ভারতের সর্বনাশ করবে। কামরাজ সখেদে বলেছিলেন যে চিঠিটির বয়ান সেই সময়ে না মেনে তিনি ভুল করেছিলেন।
অনস্বীকার্য, যাঁরা ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সর্বনাশ করতেই সচেষ্ট হয়েছিলেন শ্রীমতী গান্ধী – প্রথম ও সর্বাধিক আলোচিত দৃষ্টান্ত হলেন শ্রী অতুল্য ঘোষ – বঙ্গেশ্বর। এবং ১৯৭১ সালে শিক্ষা, সমাজ কল্যাণ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব সৈয়দ নুরুল হাসানের অভিষেকের মাধ্যমেই ভারতবর্ষের শিক্ষার অঙ্গনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয় বাম-উদারনৈতিকতাবাদ বা Left liberalism-এর যা এই মুহূর্ত পর্যন্ত তার রাজত্ব অসামান্য ঔদ্ধত্য নিয়ে বহাল রাখতে পেরেছে। সৈয়দ সাহেবের অভিভাকত্বেই Indian Council of Social Science Research (ICSSR) -এর নেতৃত্বে ২৭টি সমাজবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের শুভারম্ভ হয় সমগ্র ভারতবর্ষে এবং যার প্রভাব এই মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষুন্ন। তার মধ্যে একটি বিখ্যাত সংস্থা হল Centre for Studies in Social Sciences, Calcutta – বামপন্থার প্রাণভোমরা বললেও অত্যুক্তি হয়না।
তাহলে কি I am English by education, a Muslim by culture, just born as a Hindu by accident বলা Nehru syndrome আদতে British syndrome যা কালের গতিতে পরিণত হয়েছে বর্তমানের Left liberalism syndrome এ? ইঙ্গ-মার্কিন-রুশ স্বার্থের কাছে মাথা নোয়ানোই যার একমাত্র পরম কর্তব্য মাঠে-ঘটে ইনকিলাবী স্লোগান আওড়ানোর আড়ালে? আর যখন ভারতবর্ষ ক্রমশ imperialist British legacy থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে NRC, CAA গঠনের মাধ্যমে তাকে যেনেতেনপ্রকারে পরাস্ত করা, বিরোধিতার আগুনে জাতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা কি আন্তর্জাতিক নাট্যের একটি অঙ্ক মাত্র?
ভাবতে হবে। ভাবা প্র্যাক্টিস করতে হবে – হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এই ধারাটি ক্রমশ শক্তিশালী করতে হবে – আত্মসম্মালোচনার ঢঙেই হোক বা অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে। যা ওদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত তাই নিজেকে করতে হবে – উঠে আসবে বহু প্রতিবাদী, সমালোচনাকারী চিন্তা – সাম্রাজ্যবাদ থেকে সাম্যবাদ থেকে ফ্যাসিবাদ, নাৎসীবাদ থেকে এমনকি হিন্দু ধর্মের উদারনীতিকতাবাদের তত্বও। বহু তথাকথিত মানবিক ও প্রতিবাদী তত্বের সমাহারে মতিভ্রম ঘটানো ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কিন্তু জাতিগত স্বার্থ, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ বজায় রাখতে গেলে রাষ্ট্রব্যবস্থা হস্তগত ও পদানত করতে হয় অতীব নির্মমতার সাথে। এবং ইহাই হিন্দুত্ব।
ইতিহাস শুধু সাল, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, হর্ষ, বিবাদ, যুদ্ধক্ষেত্রের বিবরণ নয়। তা এক অতীব চলমান বিজ্ঞান – যে শক্তিসমূহের প্রভাবে আমার, আমার ধর্ম, ভাষা সমন্বিত জাতির সর্বনাশ হল তাকে চিহ্নিত করে নির্মমতার সাথে নির্মূল করার জন্যই ইতিহাস পাঠের অসীম গুরুত্ব সর্বদা রয়ে যায়।
‘অরি প্রযত্নমতি সমীক্ষ্যাত্মরক্ষয়া বসেত।।‘ – (মহামতি কৌটিল্য)
– শত্রু সর্বদাই ছিদ্রান্বেষী হয়। তাই শত্রুর আচরণ ও গতিবিহী অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করা উচিত। বিচক্ষণ রাজা সর্বদাই আত্মরক্ষার্থে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করবে।
লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী