শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উক্তি, “মনের মিলনই সত্যিকারের বিবাহ”

Blog বই বাণী

শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উক্তি, ” মনের মিলনই সত্যিকারের বিবাহ ” এর উৎস —এক শতাব্দীরও বেশি সময়কাল আগে— ১৯১৮ তে প্রকাশিত  ” দত্তা ” উপন্যাস। 
উপন্যাসটি প্রথম পড়ি কলেজ প্রথম বর্ষে। বাসে যেতে আসতে ও ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়লেও একরকম প্রত্যয় ও বিস্ময় আমাকে বারবার নাড়া দেয়। আর সেই প্রবল বিষ্ময় ও প্রত্যয় থেকে মুক্তি বা একরকম আত্মপ্রকাশের তাড়নায় আমি এই উপন্যাস আমার বেঞ্চমেটকে পড়তে বাধ্য করি, যে কিনা প্রয়োজন ব্যতীত নিছক নান্দনিক সুখের জন্য কোনো বই পড়তে কখনো আগ্রহী ছিলো না। 
কিন্তু পড়ালেখার চাপে একসময় উপন্যাসটা নিয়ে ভাবার তেমন অবকাশ পাই নি বা হয়তো আর ভাবার তাড়না অনুভব করি নি। কিন্তু কলেজ থেকে আসার পথে এক ক্লান্ত সন্ধ্যায় যখন  বাসে বসে হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকার পড়ি সেখানে প্রসঙ্গক্রমে ” দত্তা ” উপন্যাসের উল্লেখ দেখে মন চঞ্চল হয়ে উঠে। প্রফেসর সেখানে বললেন যে অনার্স পড়াকালীন তিনি অসংখ্যবার দত্তা পড়েছেন। এবং তার মতে বাংলা সাহিত্যের ” মধুরতম প্রেম উপন্যাস ” শরৎচন্দ্রের দত্তা ব্যতীত আর কোনোটি নয়। 
বইটা যদিও এখন পর্যন্ত আমার বেঞ্চমেটের কাছেই রয়ে গেছে, কিন্তু এর মাঝে কি কারণে যেনো তা কিনে আবার পড়ার জন্য মন ছটফট করতে থাকে। তাই একসময় কিনেই পড়া শুরু করে দিলাম। মন বলছিলো যে এই উপন্যাসে আরো অনেক কিছু বোঝার ও অনুভব করার আছে যা আমি বয়সের দোষে তখন ধরতে না পারলেও এখন পারবো। 
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিজয়া নামক আঠারো বছরের এক জমিদার ব্রাহ্মণ মেয়ে যাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমান দুই পুরুষের — এক হিন্দু নরেন ও এক ব্রাহ্মণ বিলাস —প্রেম অপ্রেম, স্বার্থ, চাওয়া পাওয়া, ক্ষোভ, বিদ্বেষ। 
একজন তার প্রেম প্রকাশ করেন তার অনুক্তি ও ঔদাসিন্যে আরেকজন তার প্রগলভ ঈর্ষা ও রূঢ মননে। বিপরীত ধর্মী দুই মেরুর দুই প্রেমের মধ্যে কোনটা সত্যিকার প্রেম আর কোনটা যৌবনের ক্ষণিক মোহ তাই নির্বাচন করা কাল হয়ে দাড়ায় পিতা মাতাহীন বিত্তশালী বিজয়ার। 


বিজয়ার চিত্তের এই দ্বিখণ্ডিত নগ্ন রূপ পাঠক মনে কখনো কখনো অস্বস্তি, নিদারুণ হতাশা আবার কখনো কখনো ক্রোধ, মায়া ও দুঃখের জোগান দিলেও বিজয়ার এই দ্বিখণ্ডিত চিত্তের গভীরতার ব্যাপ্তি পাঠক মনকে পুরোটা সময় পাঠে একাগ্র, আন্দোলিত ও উচ্ছ্বসিত করে রাখবে এবং তা প্রায় অবশ্যম্ভাবী । এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে বিলাসের বাবা ও পিতার মৃত্যুর পর বিজয়ার অভিভাবক ধূর্ত রাসবিহারী, আচার্য  দয়ালবাবু ও দয়ালের ভাগ্নী নিলীণি উল্লেখযোগ্য। 
এই উপন্যাসের ব্যাপকতা একটি রিভিউে সংক্ষেপে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য এক কাজ। এর হেতুও খুব সহজ। কারণ বিবাহ ও প্রেম  কভু দুজন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না ; এর সাথে পরোক্ষভাবে  জড়িত আরো অনেক মানুষের জীবন, স্বার্থ,  আকাঙ্ক্ষা ও আরো অনেক মানবিক বিষয়াবলি ; যেমন ধর্ম, রেওয়াজ, সংস্কার, জাতপাত, শ্রেণি, শিক্ষা, পেশা, পারিবারিক মর্যাদা  ইত্যাদি। এবং আমি দত্তা উপন্যাসে সবগুলোর এক পরিমিত স্বাদ পেয়ে প্রবলভাবে তাড়িত ও সমৃদ্ধ। 
এই উপন্যাস সম্বন্ধে সংক্ষেপে এরচেয়ে বেশি আর বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই ত্রিভুজ প্রেমে কারো প্রেমের কমতি ছিলো না। বরং এই ত্রিভুজ প্রেমের মধ্যে এতটাই সমতা ছিলো যে কখনো কখনো বিজয়ায় মনে হয় পৃথিবীর সকল পুরুষ একই; কেউ কারো চেয়ে কম নয় কেউ কারো চেয়ে বেশি নয়; আবার পরমুহূর্তেই যেকোনো একজনকে বেছে নেয়ার ও অপরজনকে চিরকাল হারিয়ে ফেলার ভাবনায়,  থরথর ভয়ে, চাপা কান্নার কম্পনে, বিদঘুটে কষ্ট ও দ্বিধাদ্বন্দে তার দেহ মন দুলে উঠে— হৃদয় পরিবেষ্টিত হয়ে উঠে মানব জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ  ও আদিমতম দুঃখে। 
তবে দেবদাসের মতো এটি কোনো ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি নয়, বরং এটি একটি সার্থক ও মধুর প্রেম উপন্যাস। এবং প্রেম করতে যে সাহস, দৃঢ়তা ও  অসম্ভবরকমের অনুরাগ প্রয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 
জনৈক এক সমালোচকের মতে ” সমাজ ও ধর্মব্যবস্থার অনুমোদিত, আমাদের সহজ নীতি-জ্ঞান সমর্থিত প্রেমের চিত্র শরৎচন্দ্রের অনেক উপন্যাসেই পাওয়া যায়—ইহাদের মধ্যে “দত্তা” র স্থান নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *