শিবলিঙ্গ কী?
*
লিঙ্গ শব্দটি শুনলে কয়েকটি লিঙ্গের কথা মনে ভেসে ওঠে; যেমন- ব্যাকরণের পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, উভলিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ; সমাজের লিঙ্গবৈষম্যে। সমাজে যারা খোজা, নপুংসক, বৃহন্নলা বা হিজড়া আছে সরকারিভাবে তাদেরকে দেওয়া স্বীকৃতি অনুযায়ী- তৃতীয় লিঙ্গ।
তৃতীয় লিঙ্গ বললে আবার প্রশ্ন আসে- তাহলে প্রথম লিঙ্গ এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ কারা? অনেকে বলেন পুরুষ প্রথম লিঙ্গ, নারী দ্বিতীয় লিঙ্গ এবং বৃহন্নলারা তৃতীয় লিঙ্গ। কথাটা ঠিক নয়। তৃতীয় বলতে এখানে ‘অন্য’ বোঝানো হয়েছে। যারা পুরুষ লিঙ্গও নয়, স্ত্রীলিঙ্গ নয়- এরা ‘অন্য’ লিঙ্গ অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গ। লিঙ্গ বলতে আরো যা মনে ভেসে ওঠে তা হলো- জননেন্দ্রিয় বা যৌনাঙ্গ।
লিঙ্গ আরও আছে; যেমন- লিঙ্গ পুরাণ। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয় বা ধর্মগ্রন্থ-সমাহার বা ধর্মগ্রন্থ-সঙ্কলনকে বলা হয় পূরাণ।পূরাণের সমষ্টিকে বলা হয়- মহাপূরাণ। মোট ১৮টি মতান্তরে ২০টি মহাপুরাণ আছে যার একটি হলো- লিঙ্গ পুরাণ।
এসব লিঙ্গের বাইরে আরও একটি লিঙ্গ আছে, সেটি হলো- শিবলিঙ্গ।
শিবলিঙ্গ কী দেবতা শিবের জননেন্দ্রিয় বা যৌনাঙ্গ, না কি অন্য কিছু। শিবের প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তি হিসেবে যেটিতে শিবলিঙ্গ পূজা করা হয় তার আকৃতি দেখে সাধারণভাবে অনেকের হয়তোবা ধারণা হতে পারে- শিবলিঙ্গ হচ্ছে দেবতা শিবের জননেন্দ্রিয় বা যৌনাঙ্গ। অনেকে বলেও থাকেন যে, হিন্দু নারীদের সন্তান না হলে সন্তান প্রাপ্তির জন্য তারা শিবলিঙ্গ পূজা করে, ফলে শিবের ওই প্রতীকী প্রকৃতি আসলে শিবের জননেন্দ্রিয়। প্রচলিত এই ধারণাটা ঠিক নয়।
পূরাণে নির্গুণ বলে একটা শব্দ আছে যার অর্থ গুণহীন, গুণশূন্য, গুণাতীত ঈশ্বর, পরব্রহ্ম বা পামাত্মা। নির্গুণ শব্দটি দিয়ে মূলত বোঝানো হয়েছে- অলিঙ্গ।
লিঙ্গ পুরাণে অলিঙ্গ বলতে বোঝানো হয়েছে চিহ্নহীন। চিহ্নহীন নির্গুণ মানে পঞ্চতন্মাত্র বা পাঁচটি জিনিস যথা- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ এগুলি বর্জিত। যার অনুভূতি আছে এবং পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল তার মধ্যে এই পাঁচটি জিনিস থাকবেই। কিন্তু এই পাঁচটি বিষয় বা পঞ্চতন্মাত্র অনুপস্থিত থেকেও যার অনুভূতি আছে এবং পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল সে হলো- পরমেশ্বর।
অলিঙ্গ শব্দটির বিপরীত শব্দ লিঙ্গ। অলিঙ্গ যেমন চিহ্নহীন, এর বিপরীতে লিঙ্গ তেমনি- চিহ্নযুক্ত। চিহ্নযুক্ত মানে যা অনুভূত বা গোচরীভূত। এই গোচরীভূত জিনিস বলতে বোঝায়- পঞ্চভূত। পঞ্চভূত হলো- জল- তরলের প্রতীক, বায়ু- বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী- কঠিন পদার্থের প্রতীক, অগ্নি- শক্তির প্রতীক এবং আকাশ- অন্তরীক্ষ, শূন্য স্থানের প্রতীক। পরমেশ্বরের মধ্যে এই পাঁচটি ভৌত বিষয়ও পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল।
আলোচনা থেকে বেরিয়ে এলো যে, পরমেশ্বরই হলো সেই শক্তি যার মধ্যে একইসাথে লিঙ্গ এবং অলিঙ্গ এই দুটি অবস্থাই বিরাজমান।
শিবলিঙ্গ হলো পরমেশ্বর শিবের নির্গুণ ব্রহ্ম সত্বার একটি প্রতীকচিহ্ন। ব্রহ্ম মানে সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, চিরসত্য ও পরমানন্দ যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ। ধ্যানমগ্ন শিবকে এই শিবলিঙ্গ প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। “লয়ং যাতি ইতি লিঙ্গম্”- অর্থাৎ যার মধ্যে সমস্ত কিছু লয় প্রাপ্ত হয়, তাই লিঙ্গ।
লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি সৎস্কৃত লিঙ্গম্ শব্দ থেকে যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শিবলিঙ্গ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো নির্গুণ শিবের প্রতীক। ব্যবহারিক অর্থে এটি শিবের মাথা, শিবের জননেন্দ্রিয় বা শিশ্ন নয়।
শিবের কপালে তিনটি সাদা দাগ থাকে, যাকে বলা হয়- ত্রিপুণ্ড্র। তিনটি দাগ দিয়ে শিবের কপালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। সবার নিচের অংশকে বলা হয়- ব্রহ্ম পিঠ, মাঝখানের অংশকে বলা হয়- বিষ্ণুপিঠ এবং সবার উপরের অংশকে বলা হয়- শিবপিঠ। শিবলিঙ্গের প্রকৃতিতেও এই তিনটি ভাগের চিহ্ন থাকে- এটা নির্দেশ করে যে, শিবলিঙ্গের প্রকৃতি আসলে শিবের মাথা।
সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক, এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।
শিব হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহে তিনি পরমসত্ত্বা রূপে ঘোষিত। শিব সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এই তিন কারণের কারণ। তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ। তিনি স্ব-স্বরূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি। তিনি তুরীয় অর্থাৎ ভাববিহ্বল, সমাধিমগ্ন, লোকাতীত। তিনি অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন। বেদান্ত অনুসারে তিনিই মহাঈশ্বর।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না, দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না, সৎ ছিল না, অসৎও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন। বেদ অনুযায়ী সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র শিবই বর্তমান ছিলেন। তিনিই লীলাচ্ছলে ব্রহ্মারূপ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন করেন আবার রুদ্ররূপ ধারণ করে সংহার করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-হর তারই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের তিনটি রূপভেদ মাত্র। তাই এই তিন রূপের মধ্যে সত্বার কোন পার্থক্য নেই।