শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিবর্তে রাজা রামমোহন রায়ের নামে কলকাতার বন্দরের নামকরণ করতে হবে বলে একটি চিত্তাকর্ষক, অতীব বিরক্তিকর দাবী উঠেছে। অবশ্য, রামমোহন থেকে শ্যামাপ্রসাদ পর্যন্ত অখণ্ড বঙ্গভূমিতে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার স্তর একটি নির্দিষ্ট পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছিল। ধর্ম, সমাজ সংস্কার ও স্বদেশ হিতৈষিতাই তার মূল বিষয়।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে – সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে উদারনৈতিক রামমোহনকে সম্মুখ সমরে তুলে আনার সময়েই – সেই একই সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির প্রস্তাবে কম্যুনিস্টরা ১৯৪৭-এর সেই ঐতিহাসিক লগ্নে সমর্থন দিয়েছিলেন কেন? জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ ভোট দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির সমর্থনে, রূপনারায়ণ রায় তাঁর নিজস্ব বিধানসভা ক্ষেত্রর জন্যই ছিলেন পাকিস্তানের দিকে। কিন্তু কমরেডরা সেই শ্যামাপ্রসাদের প্রস্তাবেই ভোট দিলেন শেষ পর্যন্ত!? তাঁরা অবশ্যই বিরত থাকতে পারতেন, abstention ই তো শ্রেষ্ঠ পন্হা ছিল ideological commitment বজায় রাখতে, যেমন ইউরোপীয়ান পার্টি করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল ৫৮:২১ ভোটে, না হয় ২ কমে ৫৬ হতো।
তাহলে!? এর উত্তর নিহিত আছে সিপিআই-এর তৎকালীন প্রাদেশিক সম্পাদক কম: ভবানী সেনের গ্রন্থে। ( ১৯৬৪তে অবিভক্ত সিপিআই ভাগ হলে কম: সেনম মূল সিপিআইতেই থেকে যান। ১৯৭২ সালে ওনার মৃত্যু হয় এবং অপেক্ষাকৃত বিপ্লবী সিপিআইএম তাঁর মরদেহে একটি ফুল দেওয়ার সৌজন্যতাও প্রকাশ করেনি আর তারাই এখন গণতান্ত্রিকতার পাঠ শেখাতে ব্যস্ত!!)
কম: ভবানী সেন তাঁর গ্রন্থ “বঙ্গভঙ্গ ও পাকিস্তান” গ্রন্থে লেখেন, “হিন্দু মহাসভার পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির প্রতিজ্ঞা বাঙ্গালী হিন্দু জনমনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে।” তার বিগত প্রায় ৫ বছর ইসলামী বিচ্ছিন্নতাবাদ তথা পাকিস্তান নির্মাণের পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি (বিশেষত ১৯৪৪ সালে মোহিত মৈত্রর বিতর্কিত জনসভা থেকে) বাঙ্গালী হিন্দু মধ্যবিত্ত ও প্রেসের মধ্যে কম্যুনিস্টদের প্রতি ঘৃণা উৎপন্ন করেছিল। এবং সিপিআইও হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারই ফলশ্রুতি শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির প্রস্তাবে কম্যুনিস্টদের ভোট প্রদান।
চরিত্র একই রয়েছে কম্যুনিস্টদের – নিখাদ হিন্দু বিদ্বেষ। এবং তাই আজ হঠাৎ রাজা রামমোহনের নামের প্রস্তাব যদিও ৭০ দশকের মহান বিপ্লবী (?) প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে বঙ্গীয় নবজাগরণের মনীষীদের কালিমালিপ্ত করার অভিপ্রায়ে বিদ্যাসাগরের পাশে রামমোহনের মূর্তিও ভাঙা হয়েছিল। এবং জনশ্রুতি, সেই ভাঙাতেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিপ্লবী (?) ছাত্র বিশেষ।
শ্যামাপ্রসাদের প্রতি ঘৃণা এবং রামমোহনের প্রতি হঠাৎ উথলে ওঠা প্রেমের চালচিত্র আবার বদলে যেতেও পারে tactical consideration-এর দোহাই দিয়ে। সবই স্বার্থ। আর বামপন্থী আবহের কল্যাণে অবশ্যই জানা আছে যে নিরপেক্ষ বলে কিছু হয় না। বিগত ৬০-এর দশকে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একটি সরেস cartoon/ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল ভগবান ও যমরাজের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে – কেন এদের সৃষ্টি করা হল আর কেনইবা এদের ওপরে তুলে নেওয়া হচ্ছেনা। এটি খুঁজে পেলে অবশ্যই কোন post এ দেব।
এটি অবশ্যই সেই যুগ যখন বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষতার চোখের মণি কংগ্রেস কম্যুনিস্টদের উদ্দেশ্য করে প্রতি দেওয়ালে লিখতো – চীনের দেওয়া কাস্তে-হাতুড়ী/পাকিস্তানের তারা/এরপরেও কি চিনতে হবে দেশের শত্রু কারা!! এবং এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থক ছিল পরবর্তী যুগের বামফ্রন্ট শরিক – তখনকার প্রখ্যাত বামপন্থী জাতীয়তাবাদী পার্টি – আরএসপি।
(অনেকে বলেন এত লিখে লাভ নেই। কিন্তু লিখতে হয়, বলতে হয়, তর্জনী ওঠাতে হয় – বাঙ্গালী হিন্দুর স্বার্থে, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের স্বার্থে।)
লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী