শ্রবণ ক্ষমতা আছে? তাহলে শোন দু দণ্ড –

অনিমিত্র চক্রবর্তী ভারত

সেদিনও ছিল ৩১শে জানুয়ারী, আজও তাই। সেদিনও বাতাস শীতল ছিল, আজও তাই। সেদিনও আকাঙ্খা ছিল মানুষের মধ্যে, স্বপ্ন ছিল ভালোভাবে বাঁচার – আজও তাই – হবে নাই বা কেন? এটি মানুষের মৌলিক ও আদিম প্রবৃত্তির অন্যতম। কিন্তু সেইদিন সব স্বাভাবিক ছিলনা – আজ যার সজল স্মৃতি রোমন্থন করতে পারি শুধু।

এই শীতার্ত ক্ষণেই মুছে গিয়েছিল দিন ও রাত্রির হিসেব, জলে কুমীর ও ডাঙায় বাঘ, তার চেয়েও ভয়ংকর – বন্দুকের ট্রিগারে অকম্পিত আঙুল বর্ষণ করছে গুলি – ঝাঁকে ঝাঁকে – নিরবিচ্ছিন্ন গুলির আক্রমণ আরো বেশী বেশী লাল করছে নদীর জল – অব্যক্ত বেদনার সাথে বয়ে যাওয়া রক্ত কি বেশী লাল হয়? হয়তো। এই রক্ত, স্বেদ আর শ্রমের সাথে মিশে আছে আর একটি শব্দ – প্রবঞ্চনা। মানুষের সরল বিশ্বাসকে ঠকানো প্রবল শক্তিশালী সরকার বাহাদুর দ্বারা ও যেকোন প্রশ্নকে প্রতিহত করতে গণহত্যা ঘটানো – ঘটিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গে মুক্তির অগ্রদূত রূপে কথিত বামফ্রন্ট সরকার – সর্বনাশ হয়েছিল বাঙ্গালী হিন্দুর।

কিন্তু এই নিরন্ন, পরিশ্রমী মানুষগুলোর কোন দোষ ছিলনা, শুধু তাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন – সরকারী ত্রাণের দ্বারা নয়, আদ্যন্ত সৎ পরিশ্রমের মাধ্যমে। তাঁরা নিজেরা এখানে আসেননি অস্বাস্থ্যকর দন্ডকারণ্য ছেড়ে, তাঁদের আসতে আহ্বান করা হয়েছিল – কিন্তু তাঁরা সরল মনে বোঝেননি যে স্বাধীন কর্মদক্ষতা তাঁদেরই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

পার্শ্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের মতো ভারতবর্ষেও যে বাঙ্গালী হিন্দু গণহত্যা ঘটবে তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল একসময় – ৭০এর দশকের শেষার্ধ থেকে কিন্তু তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে কম্যুনিস্ট, সেক্যুলার সরকার, সশস্ত্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে।

এই ধারার স্রষ্টা অবশ্যই মরিচঝাঁপি – যা আজ ৩১শে জানুয়ারীর গণহত্যা সূচনা করেছিল, আক্রান্ত হিন্দুর প্রতি যাতে অনুকম্পা জেগে না ওঠে মনের কোণে তাই শুধুমাত্র মুসলমানদের ব্যবহার করা হয়েছিল এই নরসংহারে – স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী। কিন্তু হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলি গেলেন কোথায়? কথিত আছে, সুন্দরবনের বাঘগুলি নাকি মানুষখেকো হয়ে গিয়েছিল হঠাৎই।

কত মানুষ নিহত হয়েছিলেন, কত নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন, কত শিশুর বলি হয়েছিল তার কোন তালিকা দূরে থাক, স্বচ্ছ ধারণাও নেই কারণ সংখ্যাটি – অসংখ্য।

মরিচঝাঁপি ফিরে ফিরে আসে প্রত্যেক অন্ধকারে, প্রত্যেক যন্ত্রণায় আকাঙ্খিত প্রত্যাঘাতের তরে।

লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *