বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মহাভারত প্রভৃতির মত রামায়ণ আমাদের একটি ধর্মগ্রন্থ। এই রামায়ণের কাহিনী যেমন আর্কষণীয়, তেননি শিক্ষাপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা এখানে রামায়ণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করছি। কাহিনীটি হল ‘শ্রীরামচন্দ্রের বনগমন।
অযোধ্যার রাজা দশরথ। তাঁর ছিল তিন রাণী। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। আর ছিল চার ছেলে। কৌশলার ছেলে রাম, কৈকেয়ীর ছেলে ভরত ও সুমিত্রার ছিল দুই ছেলে—লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। নিয়ম অনুযায়ী জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনে বসে। তাই রাজা দশরথ জ্যেষ্ঠপুত্র রামকে সিংহাসনে বসিয়ে নিশ্চিন্তে দেহ ত্যাগ করতে চান। পুরোহিত ও মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের অভিষেকের দিন নির্ধারণ করলেন। অভিষেকের কথা ঘোষিত হতেই অযোধ্যা নগরী অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে উঠল। রামচন্দ্র রাজা হবেন, প্রজাদের আনন্দ আর দেখে কে! তাদের মুখে হাসি আর হাসি, ঘরে ঘরে উড়ছে পতাকা।
“লক্ষ লক্ষ পতাকা উড়িছে নানা রঙ্গে।
নানা দেশ হইতে রাজা আসে সৈন্য সঙ্গে।।
নানা রঙ্গে রথ রথী হস্তী ঘোড়া সাজে।।
নানা জাতি বাদ্য শুনি নানা দিকে বাজে।।-রামায়ণ।
রামচন্দ্রের অভিষেকে যোগদানের জন্য বশিষ্ঠের সঙ্গে অনেক মুনি ঋষিও চলে এলেন অযোধ্যায়। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হল বেদমন্ত্র। যথারীতি অধিবাস সম্পূর্ণ হল, পরের দিন অভিষেক। ঐদিন ভোরে মন্থরা নামে এক দাসী এসে কৈকেয়ীর কক্ষে প্রবেশ করল। মন্থরা কৈকেয়ীর বাপের বাড়ির দাসী। তাকে দেখে কৈকেয়ী আনন্দে সম্ভাষণ জানালেন। রামচন্দ্র রাজা হবেন এতে সবাই আনন্দিত, কৈকেয়ীর মনে ও খুশির ভাব। কিন্তু মন্থরা রামের রাজ্যাভিষেক মোটেই সহ্য করতে পারছিল না। তার উপর কৈকেয়ীর আনন্দ দেখে একেবারে জ্বলে উঠল। মুখে বিষ ছড়িয়ে মন্থরা বলল, “তুমি ইচ্ছে করলেই ভরত রাজা হতে পারে। তোমার হয়ত মনে নেই যে, রাজা দশরথের দুবার অসুখের সময় তুমি তাঁকে সেবা করেছিলে বলে রাজা তোমাকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন, তুমি বলেছিলে সুবিধামত সে বর দুটি নেবে। এখন সুযোগ এসেছে, এই সময় তুমি সে বর দুটি রাজার কাছ থেকে চেয়ে নাও।” “কি বর চাইব রাজার কাছে?” জিজ্ঞেস করে, কৈকেয়ী।

মন্থরা বলল, “তুমি রাজার কাছে বল যে, প্রথম বরে রামের পরির্বতে, ভরত রাজা হোক, আর দ্বিতীয় বরে রাম বনে যাক। চিরজীবনের জন্য না হলেও অন্তত চৌদ্দ বছরের জন্য রাম বনে যাক।” কথাটি কৈকেয়ীর মনে ধরল। অভিষেকের পূর্বে দশরথ কৈকেয়ীর মহলে এলেন। কৈকেয়ীকে বিষন্ন দেখে রাজাও দু:খিত হলেন। কৈকেয়ী রাজার নিকট তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুত বর দুটির প্রার্থনা করলেন
“একে বরে ভরতেরে দেহ সিংহাসন।
আর বরে শ্রীরামেরে পাঠাও কানন।।”
কৈকেয়ীর প্রার্থনায় দশরথের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। তাঁর প্রাণাধিক পুত্র রামচন্দ্রকে বনে যেতে হবে। কিন্তু তিনি কি করতে পারেন? তিনি যে কৈকেয়ীর নিকট সত্যবদ্ধ। এমতাবস্থায় কৈকেয়ীকে তিনি বললেন, “তুমি অন্য বর প্রার্থনা কর।” কিন্তু কৈকেয়ী নিজের প্রার্থনায় অটল।।
অনেক অনুনয় করেও যখন কৈকেয়ীর মত পরিবর্তন করতে পারলেন না, তখন দশরথ কাঁদতে কাঁদতে রামকে। ডেকে পাঠালেন। রাম প্রস্তুত হচ্ছিলেন অভিষেকের জন্য। সব ফেলে ছুটে এলেন পিতার আহবানে। ঘরে ঢুকেই তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর পিতা কাঁদছে, মুহুর্মুহু মুৰ্ছা যাচ্ছেন। পিতার এ অবস্থা দেখে রামচন্দ্রের চোখ জলে ভরে উঠল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “পিতা, কেন আপনি আমায় ডেকেছেন? আপনার দুঃখের কারণ কী বলুন।” রাজা দশরথ যেন হতবাক হয়ে গেছে, কোন কথাই বলতে পারছে না, তাঁর চোখ থেকে অবিরল অশ্রু ঝরছে।
তখন কৈকেয়ী রামকে বললেন, “তোমার পিতা এক সময় আমাকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। এতদিন সে বর আমি চাইনি। আজ রাজার কাছে সে বর দুটি চেয়েছি। আমার প্রথম প্রার্থনা তোমার অভিষেক বন্ধ থাক- তোমার পরিবর্তে ভরতের অভিষেক হোক। আমার দ্বিতীয় প্রার্থনা, চৌদ্দ বছরের জন্য ভরত রাজা হবে। আর এ সময় তুমি থাকবে বনবাসে।”
কথা শুনে রাম পিতাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “এ জন্য আপনি দুঃখ করবেন না পিতা, আপনি আপনার সত্য রক্ষা করুন, আমি ভরতকে আশীর্বাদ করছি। সে অযোধ্যার সিংহাসনে বসুক। আমি বনে যাচ্ছি।”
রামের বনগমনের কথা শুনে রাজা দশরথ আবার মুর্ছিত হয়ে পড়লেন। রাম কিন্তু অচল অটল। পিতার সত্য রক্ষা তাঁকে করতেই হবে। পিতার জ্ঞান ফিরলে রামচন্দ্র তাঁর নিকট থেকে চলে এসে বনগমনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
এদিকে রামচন্দ্রের বনগমনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আনন্দে মুখরিত রাজধানীতে শোকের ছায়া নেমে এল। রামচন্দ্র তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে সীতার নিকট বিদায় নিতে যাচ্ছেন। পথে লক্ষ্মণের সাথে সাক্ষাৎ। সব শুনে লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের সঙ্গে বনে যাওয়া স্থির করলেন।
ওদিকে সীতাদেবীও অভিষেকের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে রামচন্দ্র গিয়ে উপস্থিত হলেন। রামের মুখে সব শুনে সীতাও তাঁর দেহের বহুমূল্য অলংকার খুলে ফেলে বললেন, “আমি তোমার সঙ্গে বনে যাব।”
‘বনবাসে অনেক বিপদের সম্ভাবনা” এই বলে রামচন্দ্র সীতাকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সীতা স্বামীর সঙ্গে যাবেনই। অগত্যা রামচন্দ্র তাঁকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন।
যে সব নরনারী কিছুক্ষণ আগে মঙ্গল ঘট আর মঙ্গল প্রদীপ হাতে নিয়ে রামচন্দ্রের অভিষেকের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা হাত থেকে সে সব ফেলে কাঁদতে লাগলেন । অযোধ্যার আকাশ কান্নায় ভরে গেল। রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য সীতা ও লক্ষ্মণসহ বনের দিকে রওনা হলেন।
বৃদ্ধ পিতার একান্ত অনুরোধে তিন দিনের পথ তাঁরা রথে যেতে সম্মত হলেন। সারথি সুমন্ত্রের রথে চড়ে তাঁরা অযোধ্যা ছেড়ে চললেন। তাঁদের পিছন পিছন ছুটে এল অযোধ্যা নগরীর প্রজাবৃন্দ। রাম ছাড়া অযোধ্যায় তারা থাকতে চায় না। তাই তারা প্রাণপ্রিয় রামচন্দ্রের অনুসরণ করছে।
রামচন্দ্র দেখতে পেলেন, রাজা দশরথ ও রাণী কৌশল্যা কাদঁতে কাঁদতে রথের পিছন ছুটছেন।
রথ বায়ু বেগে ছুটে চলল। অনেক জনপদ, প্রান্তর অতিক্রম করে তিন দিনে তাঁরা গঙ্গার তীরে এসে পৌঁছলেন। সেখানে রথ হতে অবতরণ করলেন সবাই। তারপর রামচন্দ্র বললেন, “সুমন্ত্র, তুমি ফিরে গিয়ে আমাদের সমস্ত সংবাদ জানিয়ে পিতাকে সান্ত্বনা দিও।”
সুমন্ত্র কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়ে অযোধ্যায় চলে গেলেন। পিতা, মাতা ও অযোধ্যাকে ছেড়ে যেতে রামেরও কম দুঃখ হল না। তবুও তিনি বিপদে অধীর হলেন না।
হিতোপদেশ: সম্পদ অথবা বিপদে সর্বাবস্থায় সংযম প্রদর্শন ধর্মের অঙ্গ। শ্রীরামচন্দ্র একথা স্মরণ রেখে অবিচলিত চিত্তে ভাই লক্ষণ এবং সীতাকে নিয়ে এগিয়ে চললেন।