সকল ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার বৈশ্বিক চুক্তি গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে।

Uncategorized

গতকাল একটি ঘটনা ঘটেছে। আমার ঘরে নয় –ঘটেছে বিশ্বসভায়। সকল ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার বৈশ্বিক চুক্তি গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। এই ঘটনাটিকে বড় বলব, না-কি সামান্য ঘটনা বলব? মিডিয়ার চোখে এটি সামান্যই। বিশ্ব-মিডিয়ায় এই ঘটনার বড়সড় কভারেজ নেই, বাংলাদেশেও নেই। আমি দেশের এবং বিশ্বমিডিয়ার চরিত্র প্রতিদিন নতুন করে পাঠ করছি। দিনে দিনে ধারণাগুলো বদলাচ্ছে–এতে সমৃদ্ধ হচ্ছি না সংকুচিত হচ্ছি তাও বলতে পারিনা। তবে বিশ্বাসের জায়গাটা যে ছোট হয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। একটা সময় এই বাংলাদেশেই রাজনীতির খবর, মানে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, কথাবার্তা সংবাদপত্রগুলোর মূল বস্তু ছিল। সংবাদকর্মী হিসেবে নিজে যখন এই দুনিয়ায় প্রবেশ করি, অর্থাৎ গত ২০ বছরে এই অবস্থা বদলাতে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য –এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য –এখন সংবাদপত্রের প্রতিদিনের প্রধান সংবাদ নয়। প্রধানমন্ত্রীর খবর এখন ভেতরের পাতায় চলে যায়। প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম হয় দুর্নীতির খবর অথবা মানবতার অন্য কোনো খবর। সাংবাদিকতার এই নতুন আঙ্গিককে জনগণ গ্রহণ করেছে। যে পত্রিকা যত সাহসী হয়েছে সেই পত্রিকা ততই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। সাংবাদিকতায় অবজেক্টিভিটির বিকাশ নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি। দিনে দিনে ধারণা জন্মেছে, সাংবাদিকতা শুধুই মানুষের জন্য এবং দিনে দিনে অনেক বেশি মানবমুখি হচ্ছে। পৃথিবীর এ যাবতকালের ইতিহাস হল রাজা-বাদশাদের ইতিহাস। সংবাদমাধ্যমের অতীত হল রাজা-বাদশাদের গুণকীর্তন। বর্তমানের সাংবাদিকতা মানুষের সাংবাদিকতা; আগামীর ইতিহাস হবে শুধুই মানুষের ইতিহাস। রাজা-বাদশারা নয়, মাঠের মানুষরা ইতিহাসের স্রষ্টা হবে এবং সাংবাদিকতাও মানুষের কথাই লিখবে –এই প্রত্যাশা একজন মানুষ হিসেবে আমাকে উচ্চকিত করে। কিন্তু হিসাব ভুল। বাংলাদেশ তথা বিশ্বমিডিয়া এখনো আসলে রাজা-বাদশাদেরই করতলগত।
পৃথিবীকে জানার আগ্রহ থেকে নয়, বরং ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজনে কিছুকাল থেকে বিবিসি এবং আল-জাজিরার নিয়মিত দর্শক হয়ে উঠেছি। এতে গ্লোবাল মিডিয়ায় বিশ্ববাসীর অবস্থান পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বমিডিয়ায় কি আসলেই বিশ্বের খবর থাকে? খবর তো আমেরিকার! এরপরে ইউরোপ, মানে ব্রিটেনের খবর। বাকি দুনিয়া হল ছিটেফোটা। বিবিসির এই প্রবণতাকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ করেছে আল জাজিরা। তারা যুক্তরাষ্ট্রের খবরের পর মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা মহাদেশের সংবাদ ও ফিচারগুলো সামনে আনে। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষতঃ ভারত, কদাচিত সামনে আসে। বৃহৎ পরাশক্তি চীন এবং কখনো কখনো উত্তর কোরিয়া নেগেটিভলি সামনে আসে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি রাশিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। বাকি দুনিয়া তথৈবচ!
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটাই আসলে প্রসঙ্গ। গতকাল থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক চুক্তি [UN Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW) ] কার্যকর হয়েছে। মিডিয়ায় এ খবর তুচ্ছ! কারণ যেসব দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তারমধ্যে আমেরিকা নেই। রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান – অর্থাৎ যাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে তারা কেউ এই চুক্তিতে সই করেনি। জাতিসংঘে যখন চুক্তিটি পাস হয় তখনো ঐ দেশগুলো এর বিরোধিতা করেছিল। তাদের আপত্তি উপেক্ষা করেই বিশ্বসভায় (সাধারণ পরিষদে) এই চুক্তি পাস হয়েছিল। ২০১৭’র জুলাই মাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে চুক্তিটি পাস হলেও চুক্তিতে এখন পর্যন্ত যুক্ত হয়েছে মাত্র ৫১টি দেশ। পক্ষে ভোট দিয়েছিল ১২২টি দেশ। বাংলাদেশও তার মধ্যে আছে। চুক্তি কার্যকর হয়েছে গতকাল (২২ জানুয়ারী ২০২১)। পারণাবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এটাই ইতিহাসের প্রথম চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী স্বাক্ষরকারী দেশগুলোতে এই অস্ত্রের উৎপাদন, মজুদ বা ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যাদের হাতে অস্ত্র আছে এবং যারা পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে বা বানানোর শক্তি রাখে তারাই যখন চুক্তির বাইরে থাকে –তখন ঐ চুক্তির বাস্তবিক কার্যকরতা হালকা হয়ে যায়। মিডিয়াও যথানিয়মে এই চুক্তি বাস্তবায়নের খবরকে অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু মিডিয়া মানুষের হলে কেন একে অবজ্ঞা করবে? কেন একে হাইলাইট করবে না?  পারমাণবিক অস্ত্র কি জিনিস? এ এমন এক জিনিস, যা কাউকে দয়া করেনা। যে বৃদ্ধ কিষাণ সারাজীবন ফসল ফলিয়েছে, রাজনীতির খবরও রাখেনি, সেই বৃদ্ধও এর হাত থেকে রেহাই পাবে না। যে শিশু হাঁটি হাঁটি পা–পা করছে, তাকে বাদ দিয়ে শুধু শত্রুকে খতম করার অস্ত্র এ নয়। আমেরিকা এবং রাশিয়ার হাতে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র আছে, তা দিয়ে এই পৃথিবীকে ১০ বার ধ্বংস করা সম্ভব। পৃথিবীর মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশ তাদেরই হাতে। বাকি ১০ ভাগ আছে চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত এবং পাকিস্তানের হাতে। ইসরায়েল এবং উত্তর কোরিয়াও এই ক্লাবে আছে বলে ধারণা করা হয়।। আইএস, আল কায়েদা বা তালেবানের মত কোনো ‘বিশ্বাসীদল’ পরিপূর্ণ রাষ্ট্রশক্তি কবজা করতে পারলে তারাও সর্বাগ্রে পারমাণবিক শক্তি হস্তগত করতে চাইবে। পাকিস্তান বর্তমানে সেই ঝুঁকিতে রয়েছে। মানুষের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র মজুদ করা দূরে থাক, এরকম অস্ত্র বানানো বা বানোনার চিন্তা করাও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে নিরস্ত্র মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া বা যুদ্ধ ঘোষণা করা “শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ”। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি এবং মজুদ আসলে মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ হলেও এখন পর্যন্ত একে আইনে রুপান্তরিত করে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে বিচার্য করা হয়নি। মানবতার নিয়ন্ত্রক ও শান্তির পাহারাদাররা এখনো তা হতে দেয়নি। অস্ত্রধারী ঐ দেশগুলো আসলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী। যাদের হাতে এই অস্ত্র আছে, তারা কোনোদিনই এই অস্ত্র ব্যবহার করবে না –এটা হতে পারেনা। এই অস্ত্র নিষিদ্ধ না হলে কোনো না কোনো সময় তা মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। কাজেই এর বিরুদ্ধে যখন একজন মানুষও কথা বলে তখন তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর ৫১টি দেশ যখন সম্মিলিতভাবে এরকম একটি চুক্তিতে উপনীত হয় তখন তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে প্রযুক্তি পৃথিবীর মানুষের হাতে আছে সেই প্রযুক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটদেশটিও অধিগত করে ব্যবহারের পথে যাওয়া অসম্ভব নয়। ৫১টি দেশ যখন এরকম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং তা কার্যকর করে, তখন তা শান্তির পাহারাদারদের মুখে চটিজুতার আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে হলেও এই খবর বিশ্বমিডিয়ায় প্রাধান্য পাওয়ার কথা। মিডিয়া মানুষের হলে, মানবিক হলে এবং শক্তিধরের সমালোচক হলে এটাই আজ বিশ্বমিডিয়ার বড় খবর হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *