সম্প্রতি আলোড়ন তোলা সরকারের হিন্দু আইন সংস্কার প্রস্তাবনার আদ্যোপান্ত গবেষণার দৃষ্টিতে; পর্ব ১
জাতীয় আইন কমিশন তাদের দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১০-১১ অনুযায়ী বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে UNHRC এর সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণাকে সামনে রেখে সংস্কারের চিন্তার বিষয়টি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।UNDP এর অর্থায়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আইন কমিশনকে এই পারিবারিক আইন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য সাহায্য করেছে বলে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই আইনের পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনা চললেও গঠনমূলক আলোচনা বিষয়টি তেমন পরিলক্ষিত না হওয়ায় বিষয়টি কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে পরিণত হয়েছে অনেকটা। আইনের পক্ষে বিপক্ষে উভয়পক্ষের উগ্রতায় ও প্রচারে সাধারণ সনাতনীরা বিভ্রান্ত। একটি আইনের সমর্থন করতে হলেও যেমন এটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সম্যক ধারণা প্রয়োজন, তেমনি এর বিপক্ষে বলতে গেলেও সম্যক ধারণা প্রয়োজন। বাংলাদেশ অগ্নিবীর বিদ্বৎ পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা ২ পর্বে এই আইনের আদ্যোপান্ত নিয়ে আলেচনার চেষ্টা করব।
প্রথম পর্বে আমরা দেখব যে এই আইনে আসলে কী কী আছে এবং তা কতটুকু যৌক্তিকতা রাখে বর্তমান প্রেক্ষাপটে।
আর দ্বিতীয় পর্বে আমরা হিন্দু শাস্ত্রে এই আইনসমূহ সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে, এই আইনসমূহের ইতিহাস, সনাতনী পরম্পরায় তারা কীভাবে এলো এবং আমাদের পক্ষ থেকে এই নিয়ে কী প্রস্তাবনা আছে তা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রস্তাবিত আইনের প্রারম্ভিকায় বলা হয়েছে আইন কমিশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এই ৩ শহরের মোট ২৫০ জন হিন্দুকে তারা প্রশ্নমালা প্রেরণ করেছিলেন। এদের মধ্যে বিচারক,আইনজীবী, ছাত্র, সুশীল সমাজ, গৃহিণী প্রমুখ রয়েছেন। এবং এদের ভোটাভুটির ভিত্তিতেই তারা এই আইন সুপারিশ করেছেন। আইনের প্রতিটি সুপারিশের নিচে এই ২৫০ জনের কত শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়েছেন, কত শতাংশ না ভোট দিয়েছেন তা উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণাগত পরিসংখ্যানে একটি কথা আছে যাকে আমরা বলি Sample Size. ধরুন আপনি একটি কোভিড ভ্যাক্সিন বানালেন। সেটি প্রথমে ২ ধাপ ট্রায়াল পেরিয়ে ২য় ধাপে মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীদের উপরে ট্রায়াল দিয়ে সেই ট্রায়ালে সে পাশ করলে ৩ য় ধাপে স্বেচ্ছাসেবক মানুষদের উপর ট্রায়াল চালাতে হবে।সেই ট্রায়ালে পাশ করলেই কেবল তাকে আপনি মার্কেটে আনতে পারবেন।এখন আপনি ধরুন আপনার বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য সব মিলিয়ে ১০ জন জোগাড় করলেন এবং তাদের উপর ট্রায়াল চালালেন, বাদ দিন ১০ জন না; ১০০ জনের ওপরেই চালালেন। তাতে সফল হলেও কি আপনার ভ্যাক্সিন পাশ করবে? উত্তর হলো না, করবে না। আর তার কারণ হলো স্যাম্পল সাইজ।
যে জিনিসটা আপনি সারাবিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের উপর দিতে চাচ্ছেন মাত্র ১০০ বা ১০০০ লোকের উপর ট্রায়াল চালালেই তাকে উত্তীর্ণ বলে ঘোষণা করা যাবেনা। মোট স্বেচ্ছাসেবক যাদের উপর ট্রায়াল চালানো হয়েছে তাদের সংখ্যাটা অনেক বেশী হতে হবে। আর শুধু বেশী হলেই হবে না, স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন করতে হবে সব মহাদেশে, সব অঞ্চল থেকেই। উপমহাদেশ থেকেও নিতে হবে স্বেচ্ছাসেবক স্যাম্পল, আফ্রিকা থেকে নিতে হবে,ক্যারিবিয় অঞ্চল থেকে নিতে হবে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল, বাল্টিক অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, নর্দার্ন ইউরোপ, সাউথ আমেরিকা, নর্থ আমেরিকা সকল সম্ভাব্য অঞ্চল থেকেই স্বেচ্ছাসেবক নিতে হবে, তাহলেই কেবল বোঝা যাবে সব অঞ্চলের মানুষের জন্যই এটা নিরাপদ ও কার্যকরী কি-না। কেননা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় কিছু ভেদ আছে।
ঠিক তেমনি দেড় কোটির বেশী হিন্দু জনগোষ্ঠীর এতগুলো বড় বড় সিদ্ধান্ত কোন যুক্তিতেই মাত্র ২৫০ জনের ভোটে নির্ধারিত হওয়া সম্ভব নয়। এই যে ২৫০ জন তাদেরকে কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হলো? তারা কে কে? ছাত্র যাদের কথা বলছেন তারা কারা কারা? হিন্দু শাস্ত্র ও আইন নিয়ে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সেই ছাত্র, গৃহিণী প্রমুখদের যোগ্যতা কী কী?
অনলাইন অফলাইনের সবচেয়ে সক্রিয় হিন্দুধর্ম নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিগণ প্রায় কেউই ব্যাপারটি জানতেনই না।এমন কী পদ্ধতিতে আপনারা সেই ২৫০ জন নির্বাচন করলেন যাদের মধ্যে অনলাইন অফলাইনের বিভিন্ন জনপ্রিয় হিন্দু সংগঠনগুলোর কোন কর্তাব্যক্তি, শাস্ত্রজ্ঞ কারোর ই উপস্থিতি নেই? যাদেরকে দেখা গেছে এই প্যানেলে তাদের প্রায় সবাই সরকারের আস্থাভাজন এবং কাছের মানুষ বলে প্রতীয়মান। একজন জাতীয় সংসদের বিশেষ আসনের নারী সদস্য বা একজন সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিন্দু হলেও শাস্ত্রীয় বিষয়ে তাদের যোগ্যতা কী? একটা সময় একজন অহিন্দুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির অধিকার থাকবে কিনা তা নির্বাচন করার প্যানেলে নিজেই থাকতে পারেন কী?
এখানে তো লস অব অবজেক্টিভিটির বা উনি আদৌ নিরপেক্ষ কিনা এই প্রশ্নে সেই ব্যাপারটা চলে আসবে। আর শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর ২৫০ জনকে কেন? বাংলাদেশের বাকি সব অঞ্চলে কি হিন্দুরা থাকেন না? এই আইন কি তাদের জন্য নয়? তাহলে তাদেরকে বাদ দেয়ার ভিত্তি কী? বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের হিন্দু নারীরা, যাদেরকে কেন্দ্র করেই মূলত এই আইন সংস্কারের প্রস্তাবনা তাদের ভোট না নিয়েই, তাদের মতামত না জেনেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আসীন গুটিকয়েক ব্যক্তির মতামতের আদৌ কি কোন প্রাসঙ্গিকতা আছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু খুব ই প্রাসঙ্গিক।
এবার আমরা একনজরে দেখব প্রস্তাবিত আইনে কী কী পয়েন্ট উত্থাপিত হয়েছে।
১) বিবাহ নিবন্ধন
২) বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ
৩) বহুবিবাহ
৪)অসবর্ণ বিবাহ
৫) দত্তক
৬) প্রতিবন্ধীদের সম্পত্তি দান
৭) সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার
এই ৭ টি পয়েন্টের সবগুলো নিয়েই আলোচনা করা উচিত। তা না করে কেবল ৭ নং পয়েন্টটি নিয়েই অধিকাংশ সনাতনীরা কথা বলছেন যা হতাশাজনক। নিরপেক্ষ ব্যক্তি এভাবে শুধু একপাক্ষিকভাবে কথা বলতে পারেন না, এটা দৃষ্টিকটূ।
আইন কমিশনের প্রস্তাবনায় একটি জিনিস খুব ভালো লাগার মতো আর তা হলো প্রতিটি ধারার আগেই তারা বৈদিক ধর্মের উচ্চ প্রশংসা করেছে। বলেছে বেদে বর্ণবাদ নেই, বৈদিক সমাজে সকল মানুষের সমতা ছিল, বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থান এতই উঁচুতে ছিল যে অন্য ধর্মের সেই জায়গাতে পৌঁছাতে শত শত বছর লেগেছে।
প্রথমেই আমরা একদম বিতর্কহীন ধারাগুলো নিয়ে বলব। যেমন ৩ নং ধারা বা বহুবিবাহ ধারা। পবিত্র বেদে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। ভারতেও হিন্দু বিবাহ আইনে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং একমাত্র মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়া বড় কোন সম্প্রদায়ের জন্যই বহুবিবাহ সেখানে শাস্তিযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের হিন্দু আইনে তা নিষিদ্ধ নয়। এটি খুব ই লজ্জাজনক ব্যাপার। এবং এই দফায় তারাই প্রশংসা করছে যে বহুবিবাহের অনুমতি বর্তমান আইনে থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা খুব কম ই বহুবিবাহ করে, তারা এও বলছে বেদে বহুবিবাহ নেই এবং বৈদিক যুগে মানুষ খুব ই সভ্য ছিল, নারীরা অনেক উঁচু অবস্থানে ছিল বলে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল না। তারা এখনকার আইনে যে বহুবিবাহের অনুমতি আছে তা বাদ দিতে চায়। এই পুরো দফাটাই অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং এটার জন্য আইন কমিশন প্রশংসার দাবিদার। দুঃখজনকভাবে এটাকে নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখলাম না।
এরপর আরেকটি ধারা অসবর্ণ বিবাহ বিয়ে। প্রস্তাবিত আইনে স্পষ্ট স্বীকার করা হয়েছে যে পবিত্র বেদে ও বৈদিক যুগে জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা ছিলনা যেটা আসলেই সত্য। পবিত্র বেদের বর্ণাশ্রম ধর্ম গুণ ও কর্মভিত্তিক। গীতাতেও তাই বলা আছে। তাই বর্তমানে আমরা যাকে অসবর্ণ মনে করি তা অসবর্ণ নয়। একজন ভট্টাচার্য টাইটেলের নারী প্রকৌশলী ও একজন ঘোষ টাইটেলের পুরুষ প্রকৌশলী উভয়ের বর্ণই এক, তারা সমবর্ণ। তাই টাইটেলের ভিত্তিতে অসবর্ণ ঘোষণা করে দিয়ে সেই বিয়েকে অবৈধ বলা বেদ অনুযায়ীই অপরাধ। সুতরাং অসবর্ণ বিবাহ অবৈধ এই কালো আইন বাদ করা উচিৎ, এ নিয়ে কোন বেদ মান্যকারী সনাতনী বা এমনকি কোন মানবতাবাদী মানুষের ই আপত্তি থাকতে পারেনা।
এরপরের ৫ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে দত্তক নিয়ে। প্রচলিত হিন্দু আইনে দত্তক প্রথা অত্যন্ত লিঙ্গবৈষম্যমূলক। হিন্দু পুরুষরাই কেবল দত্তক নিতে পারবে, নারীরা পারবেন না। আবার হিন্দু পুরুষরাও কেবল পুত্র সন্তানই দত্তক নিতে পারবেন, কন্যা সন্তান দত্তক নিতে পারবেন না। আধুনিক যুগে এসে এমন কুপ্রথা মানা যায়না। যেখানে ঋগ্বেদে স্পষ্ট বলা হচ্ছে-
যহো মাতরো জনযত্ন বহিমন্যঃ কর্তা সুকৃতীরন্য ঋন্ধন্।।
অর্থাৎ যখন পিতামাতার উজ্জ্বল পুত্র ও কন্যার জন্ম তখন পুত্র হয়, পরিবারের সুকৃতির কর্তা আর কন্যা হয় পরিবারের অলংকারের ন্যায়।
সেখানে পুত্র ও কন্যা সন্তান নিয়ে এরকম বিভেদ স্পষ্টত বেদের আদর্শ বিরুদ্ধ।
মহাভারতেও আমরা দেখতে পাই মাতা কুন্তীকে দত্তক নিয়েছিলেন রাজা কুন্তীভোজ।অর্থাৎ হিন্দুধর্মে পুত্র সন্তান,কন্যা সন্তান সবাইকেই দত্তক নেয়া যায়।তাহলে কেন বিদ্যমান হিন্দু আইনে কন্যা শিশুকে দত্তক নেয়া যাবেনা?
নিঃসন্তান পুরুষ বা স্ত্রী যেকোন কারো কাছেই সন্তান লালনপালন করা অনেক বড় একটা স্বপ্ন হতে পারে।এতে বাধা দেয়া অমানবিক। আবার প্রকারান্তরে দত্তক নেয়ার আইন পুরোদমে থাকলে সমাজের অনেক ছিন্নমূল শিশু নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে। পবিত্র ঋগ্বেদের ৮ম মণ্ডলের ৯ম সূক্তটির একটি বড় অংশই সমাজের অনাথ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে মানবজাতিকে নির্দেশনা দিয়েছে। একজন অনাথ শিশু কন্যাও হতে পারে, পুত্রও হতে পারে।
তাই এই দফাটিও যৌক্তিক না বলে উপায় নেই।
এরপরের দফায় এসেছে প্রতিবন্ধীদের কথা। আইন কমিশন বলছে প্রচলিত হিন্দু আইনে শারীরিক মানসিক প্রতিবন্ধীরা বর্তমানে সম্পত্তি পান না। এতে তাদের জীবন অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিভীষিকাময় হয়ে দাড়ায় অনেকখানে। ভারতে হিন্দু আইনের মিতাক্ষরা শাখার অনুসরণ হয় এবং সেখানে The Hindu Inheritance (Removal Of Disabilities Act), 1928 রদ হওয়ায় প্রতিবন্ধীরাও সম্পত্তি পান যা দায়ভাগ শাখার অনুসারী বাংলাদেশের হিন্দু আইনে পায় না। উচ্চ আদালতের সুরক্ষা বলয়ে প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের সম্পত্তির সুরক্ষা দেয়া হবে, এই শর্তে এই দফাটিও অত্যন্ত যৌক্তিক ও মানবিক বলেই মনে হয়েছে।
২য় দফায় বলা হয়েছে বিধবা বিবাহ নিয়ে। সনাতন ধর্মে বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন, বেদমন্ত্র উচ্চারণে সপ্ত প্রতিজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক।তাই সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অতি অল্প। আইন কমিশনের প্রস্তাবনাতেও এই কথাটি প্রশংসার সাথে বলা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে সনাতন ধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। দেশের দেড় কোটির অধিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন সংসারেই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট মর্মান্তিক কারণ নেই এই ধরনের দাবী করা একদম ইশপের গল্পের মতই কাল্পনিক।
এমনকি পরকীয়ারত স্ত্রী হিন্দু উকিল স্বামীকে খুন করে মাটি চাপাও দিয়ে দিয়েছে এমন ঘটনাও আছে। বিবাহিত পুরুষ বা নারী ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যের সাথে পালিয়ে গেলে তখন সেই বিয়ের কী হবে? সেই বিপত্নীক স্বামী অথবা বিধবা স্ত্রীর তো অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে পুনরায় বিয়ে করার অনুমতি থাকা অযৌক্তিক না। (এখানে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে মৃতের সমান ধরা হয়েছে মনুস্মৃতি ৯.২১১ এর পতিত ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির ২.১৪০ এর আশ্রমত্যাগী,পিতৃদ্বেষী সূত্র অনুসারে)।
আবার পরাশর স্মৃতিতেও শ্লোক পাওয়া যায় বিধবাবিবাহের প্রসঙ্গে যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “বিবাহ বিবাহের প্রচলন হইতে পারে কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার” এর ১ম খণ্ডে উল্লেখ করেছিলেন এবং এই শ্লোকটি তৎকালীন ভারববর্ষে বিবাহ বিধবা আইন পাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল-
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যোবিধিরতে।”
(পরাশর স্মৃতি ৪.৩০)
অর্থাৎ স্বামী চরিত্রহীন হয়ে পাপ দ্বারা পতিত হলে, মারা গেলে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে (অনুমতি ব্যাতিরেকে) বা বহুবছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকলে বা ক্লীব হলে স্ত্রী পুনর্বিবাহ করতে পারে।
একই ধরনের বিধান পুরুষের জন্যও রাখতে হবে এই শর্তে আরও কিছু সংযোজন বিয়োজন করে, নির্দিষ্ট স্পষ্ট কী কী কারণে বিচ্ছেদ আইনসম্মত ধরা হবে তা উল্লেখপূর্বক পুনর্বিবাহের আইন, বিধবা বিবাহের আইন রাখা রাখা যেতে পারে।
বিপত্নীকরা যদি বিয়ে করতে পারেন তাহলে সঙ্গত কারণে বিধবারা কেন করতে পারবেন না?তবে হ্যাঁ দুই ক্ষেত্রেই কারণ অতি যৌক্তিক ও স্পষ্ট হতে হবে, একে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে না নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেকোন পুরুষ বা নারী যদি তার স্ত্রী বা স্বামী কর্তৃক অসহ্য নির্যাতনের বা প্রতারণার স্বীকার হয় তার শর্তসাপেক্ষে অধিকার থাকা উচিৎ বিচ্ছেদের। তবে অবশ্যই এইক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ম রাখতে হবে যাতে করে এই আইনের অপব্যবহার করার সুযোগ খুব সীমিত থাকে। তবে এটা জেনে রাখা ভালো যে বাংলাদেশের হিন্দু আইনে আগে থেকেই সেপারেশনের আইন আছে, সেটাও একপ্রকার ডিভোর্স ই। তাই ডিভোর্সের আইন নতুন করে করা হলেও নতুন কিছুই আদতে যোগ হচ্ছে না।
আর বিভিন্ন অবৈধ পুনর্বিবাহ এবং বিয়ে করেও পরিবার, সন্তানকে ফেলে অন্য ধর্মের কারো সাথে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরকে তাদের প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী আইনের আওতায় এনে বিচার করতে চাইলে সেই বিচ্ছেদের আগে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, লাগবে লিগ্যাল ডকুমেন্ট, বিয়ের প্রমাণ। সেই দোষী ধর্মান্তরিতকে আইনিভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে এবং এরকম আইনি জটিলতায় সাহায্যের জন্য বিয়ের দালিলিক প্রমাণ রাখা যেতে পারে। তবে আইন কমিটি যে সুপারিশ করেছে যে রেজিস্ট্রেশনের সাথে হিন্দু বিয়ের বৈধতার কোন সম্পর্ক থাকবেনা সেটা অবশ্যই বলবৎ রাখতে হবে। কেননা হিন্দু বিয়ে কোন চুক্তিনামা নয় যে রেজিস্ট্রেশনের উপর এর বৈধতা নির্ভর করবে। একমাত্র বেদমন্ত্রের উচ্চারণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাই এর বৈধতানামা। তাই বিয়ে রেজিস্ট্রেশনকে ঐচ্ছিক এবং কেবলমাত্র বিপদে আপদে আইনি কাজে সহযোগিতার জন্য দেয়া পত্র হিসেবে বিবেচনায় রাখা হলে তাতে তেমন সমস্যা হবার কারণ দেখি না।
সর্বশেষ এবং সর্বপ্রধান যে দফা সেটা হলো নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার। এই বিষয়ে একটা কথা বহুল প্রচলিত যে আমাদের দেশে কি হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি পায় না? হয়তো প্রায় সবাই উত্তর দেবে না,পায় না।
কিন্তু এই কথাটাকে পুরোপুরি সত্য মানা যায়না। কেননা মেয়েরা স্থাবর সম্পত্তি না পেলেও অস্থাবর সম্পত্তি যেমন অর্থ,অলংকার ইত্যাদি রূপে অস্থাবর একটা ভাগ বিয়ের সময় পায় যেটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।সমস্যা হলো বর্তমানে সেই জিনিসটা মেয়ের সম্পত্তি হিসেবে নয় বরং পাত্রপক্ষের অন্যায় এবং বাধ্যতামূলক “দিতেই হবে” এমন আবদার হিসেবে ব্যয়িত হয়।ফলে দেখা যায় ঠিকই পিতা সম্পত্তির ভাগ অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে দিচ্ছে কিন্তু তা তার মেয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অধিকার বা সামর্থ্য প্রতিষ্ঠায় কোন কাজে লাগছে না। প্রাচীন সনাতনী পরম্পরায় মেয়েদেরকে বিয়ের সময় পিতৃকূল থেকে এভাবে অস্থাবর সম্পত্তির রূপেই পৈতৃক সম্পত্তি দেয়া হতো। এই সম্পত্তিকে বলা হতো স্ত্রীধন। এই স্ত্রীধনে অধিকার ছিল কেবল মেয়ের একার,স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোক তা চাইলেই ভোগ করতে পারত না। ফলে মেয়েটি তার নিজেরও একচ্ছত্র যথেষ্ট সম্পত্তি আছে এই অর্থনৈতিক ও মানসিক শক্তিতে বলীয়ান থাকতো। কিন্তু বর্তমানে যৌতুক প্রথার কারণে যে স্ত্রীধন স্বামীর ভোগ করা নিষিদ্ধ তা উল্টো স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি হয়ে গেছে,মেয়ের ই তাতে তেমন দখল থাকে না। ফলে পিতা স্ত্রীধন রূপে সম্পত্তি দিলেও তা মেয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগে খুব কম, হয়ে যায় যৌতুক।
অর্থাৎ আপনি আপনার মেয়েকে সম্পত্তি দেবেন কিনা সেটা তো পরের বিষয়, তাকে আপনি যাই দেন না কেন সেটা যে উদ্দেশ্যে দিচ্ছেন অর্থাৎ মেয়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য সেটা না হয়ে যদি সেটা পাত্রপক্ষের বস্তুগত লোভ চরিতার্থ করার উপায় হিসেবেই কেবল ব্যবহৃত হয় তাহলে তা দিয়ে কিন্তু কোন উপকার হচ্ছেনা।
এছাড়া বর্তমান সমাজে আমরা মেয়েদের শিশুকাল থেকেই সুশিক্ষা, আত্মনির্ভরশীলতা ও জাগতিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে সমানভাবে টিকে থাকার শিক্ষা ছেলেদের মতন করে সমানভাবে দিতে পারি নি। এখনো বিশাল একটি অংশে মেয়েদের শিক্ষার ভালো সুযোগ নেই, তাদেরকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘরের পুতুল করেই বড় করছে। যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘরের ছেলে সন্তানটি প্রতিযোগিতামূলক জগতে যতটা জায়গা করে নিতে পারছে মেয়েটি তা পারছে না। তার পদচারণা ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এমনকি একজন শিক্ষিত চাকুরীজীবি মেয়েও যাতে একটি ছেলের মতো সমানভাবে সবখানে পদচারণা রাখতে পারে, সেই পরিবেশ গত শত শত বছরে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এর ফলে হঠাৎ করেই এখন রাতারাতি আইন পরিবর্তন করেই আমরা তার ক্ষতিপূরণ করতে পারব না। কেননা মনের অজান্তেই আমরা মেয়েদেরকে পুতুল বানিয়ে রাখতে গিয়ে ছেলেদের উপর পিতামাতার ভরণপোষণ সহ বিভিন্ন দায়িত্বের অসম চাপ দিয়ে ফেলেছি যাকে সমাজ তথাকথিত পৌরুষের অংশ মনে করলেও বাস্তবে এটি পুরুষদের নিজেদের ই সৃষ্ট অসমতা যা পৌরুষত্বের মিথ্যা মোহে আমরা বুঝতে পারি না। তাই আমাদের এত শত বছরের সামাজিক যে অসম কাঠামো আমরা গড়ে তুলেছি তা আগে ভাঙতে হবে। শতভাগ দূর করতে হবে যৌতুক নামের কুপ্রথা, ছেলেরাই কেবল ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নেবে এই মিথকে ভাঙতে হবে, মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই বিদ্যমান সমাজে ছেলেদের মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হবে। তার আগে হঠাৎ করেই এই আইন আমাদের এত শতকের করা এতগুলো ভুলকে একদিনে শুধরে দিতে পারবে না। এতে বরং ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ছেলেটি ভাববে ভরণপোষণের দায়িত্ব তো প্রায় জায়গায় আমাকেই নিতে হচ্ছে, তাহলে আমি কেন সমান পাবো? মেয়েটি সম্পত্তি পেলেও তার স্ত্রীধন তার লোভী শ্বশুরবাড়ির খপ্পরে পড়ে পরিণত হবে যৌতুকে। আর সেই মেয়েটিকে আমরা পুরুষরাই ছোটবেলা থেকে তার সম্পত্তি কীভাবে রক্ষা করতে হবে সেই ক্ষত্রিয় শিক্ষা দিই নি। আবার তাকে কীভাবে তার ভাইটির মতো করে সমানভাবে প্রভাব খাটাতে হবে পরিবারে, দায়িত্ব নিতে হবে সেই শিক্ষাও দেয়নি পরিবার শৈশবে, তাকে বড় করেছে পুতুলের মতো করে। এই নির্মম সমাজিক বাস্তবতাগুলো মাথায় না রেখে কোন কার্যকর আইন করা কঠিন ব্যাপার।
তবে এই কথা অস্বীকার করলে চলবেনা অনেক পরিবার ই বর্তমানে আছে যেখানে মেয়ে সন্তানটিই তার পরিবারকে দেখে, ছেলে সন্তান নেই বা থাকলেও উচ্ছৃঙ্খল বা বয়সে বোনদের চেয়ে অনেক ছোট। আর এই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে যা প্রশংসনীয়। এসব ক্ষেত্রেও কিন্তু বাবা মাকে মোহশূন্য হয়ে সেই দায়িত্ব পালনকারী মেয়েকে নিজ উদ্যোগে উইলের মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে যথাযোগ্য সম্পত্তির মর্যাদা দিতে হবে। সবখানেই মুখস্থ নিয়ম মেনে চললেই হবে না।
যৌতুককে অবশ্যই অবশ্যই দূর করতে হবে, একদম শতভাগে নির্মূল করতে হবে। যৌতুক যতক্ষণ পর্যন্ত দূর করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত আইনের সঠিক ব্যবহার কোনভাবেই সম্ভব না। আমরা যতই নীতিকথা বলি না কেন, একটি পরিবারে ৩ বোন ১ ভাই হলে সেই ৩ বোনের বিয়েতে যৌতুক দিতে দিতেই বাবা মায়ের সম্পত্তির বিশাল অংশ খরচ হয়ে যায়। তারপরে যা বাকি থাকে তাও সমান অংশ তাদেরকে আবার দিলে ছেলে সন্তানটিই বরং বৈষম্যের স্বীকার হবে।
আর এখানে কিন্তু সেই ৩ মেয়ের কোন দোষ ই নেই। কেননা যৌতুকটা তারা মনের ইচ্ছায় দিচ্ছে না, দিচ্ছে পাত্রপক্ষের চাপে অর্থাৎ পুরুষদের চাপে। তাই পুরুষরা এই দায় এড়াতে পারেন না। পুরুষরা যৌতুক না নিলে এই সমস্যার সিংহভাগ ই দূর হয়ে যেতো।
এই প্রস্তাবিত আইনটির আরও বড় একটি সমস্যা হলো এখানে সম্পূর্ণভাবে পরিস্কার করা হয়নি যে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি কীভাবে সম্পত্তি পাবেন। বলা হয়েছে কোন হিন্দু সম্পত্তি পাবার পূর্বে ধর্মান্তরিত হলে সে আর সম্পত্তি পাবে না। কিন্তু ধরুন একটি ছেলে বা মেয়ে সম্পত্তি পাবার পরে ধর্মান্তরিত হলো। তাহলে কী হবে?
এই আইনটি যারা খসড়া করেছেন তারা খুব কাঁচা বাংলায় তাড়াহুড়ো করেই খসড়াটি করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। ভাষা ও যতিচিহ্ন ব্যবহারে প্রচুর ভুল এবং ভাষা অস্পষ্ট। যেমন এই আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে-
“কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) যদি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি গ্রহণ করার পূর্বে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা ধর্মান্তরিত না হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির অংশটি তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সমান অংশ পাবেন।”
সমস্যাটা খেয়াল করুন। ধরুন একটি ছেলে তার নাম “ক”। সে বিয়ে করলো একটি হিন্দু মেয়েকে, তার ছেলেমেয়েও হলো কিন্তু এখনো তার বাবা বেঁচে আছে বলে সম্পত্তি ভাগ হয় নি। এই অবস্থায় সে ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে সে কোন সম্পত্তি পরবর্তীতে পাবে না, তবে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে হিন্দুধর্মে থেকে গেলে তারা সেই সম্পত্তি পাবে। খুব ভালো কথা।
কিন্তু খেয়াল করুন “তারা হিন্দু থেকে গেলে” এরকম কোন কথা স্পষ্ট করা হয়নি এই আইনে। এমনও তো হতে পারে সে সম্পত্তি ভাগ হবার আগে বিয়েই করেছে অহিন্দু কাউকে নিজে ধর্মান্তরিত হয়ে। তো তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েও সবাই তখন অহিন্দু এবং সেই স্ত্রী ছেলেমেয়ে তো আর নিজেদের ধর্ম পরিবর্তন করেনি,তারা জন্ম থেকেই অহিন্দু। তাহলে কী সম্পত্তি সেই অহিন্দু স্ত্রী, ছেলেমেয়ে পাবে? তাহলে তো উল্টো সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেলো হিন্দুদের কাছ হতে!আবার একটা হিন্দু মেয়ে তার হিন্দু স্বামী, হিন্দু সন্তানকে ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে চলে গেলে তার হিন্দু স্বামী এবং সন্তানরা কী সম্পত্তি পাবে কিনা তাও পরিস্কার করা হয়নি কারণ ধারায় শুধু “স্ত্রী” শব্দটা আছে, স্বামী শব্দটা নেই।
এখানে অবশ্যই এই ধারা থাকতে হবে যে “ক” নামক ছেলে বা মেয়েটি সম্পত্তি বাবা থেকে পাবার শুধু আগে নয়, এমনকি সম্পত্তি ধরুন পেয়ে গেছে। পেয়ে যাবার ২০ বছর পরেও যদি সে ধর্মান্তরিত হয়ে যায় সরকার তার সেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তার নিকটস্থ সপিণ্ড ও সগোত্র যে হিন্দু আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিবে। আর এরইমধ্যে সে যদি সেই সম্পত্তি বিক্রয় করে ফেলে তাহলে তাকে ঋণখেলাপি আইনের আওতায় তার কাছ থেকে সমমূল্যের টাকা বা অন্য বিকল্প সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তা নাহলে হিন্দুরা অনেক সম্পত্তি হারাবে। এই কথা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কেননা ধর্মান্তরিত শুধু মেয়েরা হন না, ছেলেরাও হন প্রচুর পরিমাণে। তাই এই দায় শুধু মেয়েদের উপর চাপানো অযৌক্তিক। মূল কথা হলো এটা স্পষ্ট উল্লেখ করতে হবে যে এই সম্পত্তির মালিক কখনোই কোন অহিন্দু হতে পারবে না। কেউ ধর্মান্তরিত হলেই তার সেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো হিন্দুরা তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেননা।দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে হিন্দুরা বর্তমানে খুবই লোভী।জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি অতিমাত্রায় লোভের কারণে তারা তাদের সন্তান ৫ মিনিটও ধর্মশিক্ষার পিছনে ব্যয় করুক তা চাননা।এমনকি শিশু নিজে থেকে ধর্মশিক্ষা নিয়ে আগ্রহ দেখালেও তারা ধমক দেন এবং বলেন স্কুলের পড়ার বই পড়তে কারণ তাতে ভালো রেজাল্ট হবে,ভালো চাকরি পাবে।আবার সেই তারাই এখন কান্নাকাটি করছেন ধর্মান্তরিতদের জায়গা জমি হারানো নিয়ে।এই কথাগুলো যখন টাকাপয়সার লোভে লালায়িত হয়ে সন্তানকে দিনরাত টাকা বানানোর মেশিন তৈরী করতে ব্যয় করেছেন তখন আপনাদের মনে থাকেনা? আপনি ধর্মের জন্য জীবনে এমন কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন যে আপনার সন্তান ধর্মান্তরিত হবেনা? কর্ম করলে সেই ফল ভোগ করতেই হবে। আপনার নিজের ব্যর্থতার দায়,লোভের দায় এখন সম্পত্তির উপরে দিচ্ছেন কেন?
যাই হোক,শাস্ত্রে স্পষ্ট লেখা আছে পতিত বা মৃত বা আশ্রমত্যাগী ব্যক্তির সম্পত্তি তার সপিণ্ড-সগোত্রদের কাছে ফেরত চলে যাবে
(মনু ৯.২১০-২১১,যাজ্ঞবল্ক্য ২.১৪০)।
একজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি অর্থাৎ আশ্রমত্যাগী ব্যক্তি বা তার অহিন্দু স্বামী বা স্ত্রী ও অহিন্দু সন্তান সন্ততি কোনভাবেই যেন সম্পত্তি না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে,এই ব্যাপারে কঠোর আইন ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নিশ্চিত না করলে এই নতুন আইন বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো একটি অহিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যেখানে সরকার হিন্দুদের নিজেদের জমিজমার ই নিরাপত্তা দিতে পারছে না, বরং অর্পিত সম্পত্তি আইনের নানা জটিলতায় সরকারের কারণেই অনেক হিন্দু নিজের জমি হারাচ্ছেন, সেখানে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়া একজন অহিন্দুর জমি সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন, এটা কি বাস্তবে সম্ভব?
পুত্র ও কন্যা উভয়েই পিতামাতার জন্য সমান আদরের, সমান মর্যাদার। তাই অবশ্যই দুজনের ই পিতামাতার সবকিছুতে সমান অধিকার রয়েছে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাজের বিকৃত কাঠামো সেই অধিকারের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে নারী কি তার অধিকার পাবেনা হিন্দুধর্মে? সম্পত্তির অধিকার কি শুধুই পুরুষের? সনাতন ধর্ম সর্বদাই মানবিকতার, সমতার ধর্ম। তাই নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই এখানে সবকিছুর সমান অধিকার প্রাচীন আইনবিদ ঋষিগণ নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু কী উপায়ে তারা উভয়ের জন্য সম্পত্তির সমবন্টন নিশ্চিত করেছেন তা আমরা কেউ না জেনেই তুমুল তর্ক বিতর্ক করে চলেছি গত কয়েকদিন ধরে। আর আগামী পর্বে সেই রহস্যের ই উন্মোচন হবে।
আগামী পর্ব যেটা এই প্রবন্ধ সিরিজের আসল পর্ব,মূল পর্ব, সেখানে আমরা দেখব শাস্ত্রীয়ভাবে আসলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার, নারী পুরুষের অধিকার শাস্ত্র অনুযায়ী কেমন,হিন্দু আইনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং সম্পত্তি নিয়ে এই বিবাদের শাস্ত্রীয় ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে আমাদের বিশদ গবেষণা ভিত্তিক প্রস্তাবনা।এই পর্বটি ছিল মূলত আমাদের আগামী মূল পর্বের একটি ভূমিকা মাত্র।তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আগামী পর্বটি না পড়েই কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য না করার।সবাই ভালো থাকবেন,সুস্থ্য থাকবেন ও নিরাপদে থাকবেন।
নমস্কার
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক