সাতচল্লিশে বিশ্বের বুকে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ১২০০ মাইল দূরবর্তী দুটো ভূখণ্ড নিয়ে বিশ্বে বিষফোঁড়ার মতো জন্ম নিল পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র। একাত্তরে রাষ্ট্রটি তার চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করল। ধর্মের ভিত্তিতে যে একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না, সেটি প্রমাণিত হলো। পাকিস্তানের উগ্র মুসলিম শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ অংশের হিন্দুদের ওপর চালাল নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কিন্তু দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে সংবিধান ধর্ষিত হলো; যে ধর্মকে পুঁজি করে পাকিস্তানি ও জামায়াতিরা একাত্তরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, এই দুজন সংবিধানে ফের সেই ধর্মকে পুনর্বাসিত করলেন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে। পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্র থেকে বেরুতে-না-বেরুতেই বাংলাদেশ পরিণত হলো আরেকটি সিকি ধর্মরাষ্ট্রে!
বিরানব্বইয়ে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো, সেই ধ্বংসের প্রভাবে কচুকাটা হলো বাংলাদেশের হিন্দুরা। ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জেতার পর হিন্দুরা ফের তাণ্ডবের শিকার হলো। ২০১৩ সালে সাইদির ফাঁসির রায়ের পর হিন্দুরা আরেক দফায় জাতীয়তাবাদী-জামায়াতিদের ধ্বংসযজ্ঞের কবলে পড়ল। একাত্তর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে হিন্দুনিধন অব্যাহতভাবেই চলছে।
ভারতে ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ হয়, দাঙ্গায় দুই পক্ষের অংশগ্রহণ থাকে; বাংলাদেশে যা হয়, তা ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ নয়, তা ‘সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস’। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে একপক্ষ তাণ্ডব চালায়, অপরপক্ষ মার খায়; বাংলাদেশে কেবল মুসলিমরা তাণ্ডব চালায়, বৌদ্ধ-হিন্দুরা মার খেয়ে যায়।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে একেকটি দেশে একেকটি সম্প্রদায় ‘সংখ্যালঘু’; বাংলাদেশে যেমন হিন্দু-বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু, তেমনি ভারত-মায়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিমরা। গুজরাটে-অযোধ্যায় আমরা শত মুসলিমের লাশ পড়তে দেখেছি বিজেপি-শিবসেনা-আরএসএসের লেলিয়ে দেয়া হিন্দু জঙ্গিদের হাতে, মায়ানমারের উগ্র বৌদ্ধদের হাতে পিষ্ট হতে দেখেছি অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে। তিন ভূখণ্ডে ত্রিমুখী ধর্মতাণ্ডব চলছেই!
অথচ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের ধর্মকে ‘শান্তির ধর্ম’ বলে দাবি করে। ধর্মগুলো কতটা শান্তির— এর প্রমাণ আমরা এই দক্ষিণ এশিয়ায় দেখে চলছি হাজার বছর ধরে। আমরা হিন্দুধর্মের শান্তির প্রমাণ দেখেছি শিবসেনার রামদা থেকে ঝরে-পড়া মুসলিমের রক্তে, আমরা ইসলামধর্মের শান্তির প্রমাণ দেখেছি জামায়াতিদের জ্বালিয়ে-দেয়া হিন্দুবাড়ির দাউদাউ আগুনে, আমরা বৌদ্ধধর্মের শান্তির প্রমাণ দেখেছি উগ্র বৌদ্ধদের হাতে গলা-কাটা রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তে লাল-হওয়া নাফ নদীর জলে! ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষকরা বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমারজুড়ে অপূর্ব শান্তির মহড়া দিয়ে চলছেন! এই অঞ্চলজুড়ে একটি অদ্ভুত ধর্মশ্রেণি গড়ে উঠেছে; যেটি ‘মডারেট মুসলিম’, ‘মডারেট হিন্দু’ কিংবা ‘মডারেট বৌদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই মডারেটগণ মনের ভুলেও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন না; আবার ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদের ধর্মানুভূতিও হতাহত হয় এবং তারা তোতাপাখির মতো বলে ওঠেন— ‘আমাদের ধর্ম শান্তির ধর্ম। আমাদের ধর্ম হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। যারা ধর্মের নামে খুনখারাবি করে, তারা প্রকৃত ধার্মিক নয়।’ একেকটি ধর্মের যে অংশটি সন্ত্রাসে সম্পৃক্ত, তারা সংখ্যায় নিতান্তই কম; সংখ্যায় বেশি হচ্ছে ঐ মডারেটরা। ‘শান্তির ধর্ম’-‘শান্তির ধর্ম’ বলে মুখে ফেনা-তোলা এই মডারেটরা এক হয়ে ঐ কতিপয় ধর্মসন্ত্রাসীকে রুখে দাঁড়ালে আর সন্ত্রাস ঘটতে পারত না। কিন্তু মডারেটগণ কখনোই এই কাজটি করে না, বরং অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর তাণ্ডব হলে তারা মনে-মনে পুলকই অনুভব করে! সংখ্যালঘিষ্ঠ হিংস্র ধর্মসন্ত্রাসীদের চাইতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মিচকে মডারেটরা পৃথিবীর জন্য অধিক ক্ষতিকর।
ধর্মীয় সন্ত্রাসে বাংলাদেশে এ যাবৎ কত হিন্দু-বৌদ্ধ হতাহত হয়েছে, এর ইয়ত্তা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে হিন্দু-বৌদ্ধদের চেয়েও সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে খ্রিষ্টানরা কম নির্যাতিত হন, বাংলাদেশে গির্জায় আক্রমণ হয় না বললেই চলে; কেননা বাংলাদেশের ধর্মসন্ত্রাসীরা জানে— গির্জা ধ্বংস হলে মার্কিন-ব্রিটিশ বাবারা তাদেরকে নির্মমভাবে টাইট দেবে। কিছু দিন আগে শিবিরের একটি মিছিল থেকে মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়িতে কিছু ঢিল পড়েছিল, পরে জামায়াত মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গেছে!
বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত হিন্দুদের ওপর হামলা করে পরিকল্পিতভাবে। আওয়ামি লিগ সেই হামলা বন্ধে খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে চোখে পড়েনি; লিগের আমলেও বাংলাদেশে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের ওপর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়— লিগও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে সক্ষম না; বরং হিন্দু-বৌদ্ধ নির্যাতনের কোনো-কোনো ঘটনায় স্থানীয় লিগনেতাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া গেছে! অবস্থাদৃষ্টে মাঝে-মাঝে মনে হয়— বিএনপি-জামায়াত এই যে সংখ্যালঘুনির্যাতন করে, এটি লিগের জন্য এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ; এই ইশুকে পুঁজি করেও লিগ অনেক সময়ে সংখ্যালঘুদের ভোট কবজা করে। বাংলাদেশে কোনো দলই সংখ্যালঘুনির্যাতন দমন করতে পারল না। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসে, প্রতিটি দিনের শেষে ততবারই দেশজুড়ে ধ্বনিত হয় একটি বাক্য— বাবারা, তোমরা একজন-একজন করে আসো; আমার মেয়েটা খুব ছোট!
রুপম দাশ।।।
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ।