সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে প্রচলিত পাঁচটি ভুল ধারণা –

Uncategorized
সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে প্রচলিত পাঁচটি ভুল ধারণা –
১- সিরাজউদ্দৌলা বাঙ্গালী ছিলো।
সঠিক তথ্য – সিরাজ ছিল তুর্কি জাতির লোক। সিরাজের দাদু ছিলো আলীবর্দী খান।
আমরা জানি যে আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না। তার ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই সে নিজের বড়ভাই “হাজি আহমদ”-এর তিন ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।
বাপের জন্মে কখনো শুনেছেন যে বাঙ্গালীর ঘরে জেঠতুতো – খুড়তুতো ভাইবোনের এইভাবে হোলসেলে বিয়ে হয়?
যাইহোক এই সিরাজের দাদু আলিবর্দী বা ঠাকুর্দা হাজি আহমেদের বাবা ছিলো মির্জা মুহম্মদ। মির্জা মহম্মদ ছিলো তুর্কি বংশোদ্ভূত! অর্থাৎ সিরাজ ছিলো আদতে তুর্কি‚ বাঙ্গালী না। 
আবার এই মির্জা মহম্মদের বউ মানে সিরাজের ঠাকুরমা ছিলো ইরানের খোরাসানের এক তুর্কি উপজাতির মেয়ে। তার ঠাকুরদা আবার ছিলো আওরঙ্গজেবের সৎ ভাই। যে আওরঙ্গজেবের বংশ একদিন ভারত দখল করেছিলো এখনকার উজবেকিস্তান থেকে এসে। মানে কোনো দিক থেকেই সিরাজের কোনো বাঙ্গালী কানেকশন পাওয়া যায়না। 
এমনকি সিরাজের দাদু আলিবর্দী তো বাঙ্গালায় এসেছিলোই ১৭২০ সালে! 
যে ফ্যামিলিকে বাঙ্গালী বানিয়ে গ্রেটার বাংলার মিশনে নেমেছে নির্দিষ্ট কিছু পক্ষ।
২ – সিরাজ ছিলো বাঙ্গালার শেষ স্বাধীন নবাব।
সঠিক তথ্য –  শেষ নবাব তো দূরের কথা‚ সিরাজ কোনো নবাবই ছিলো না। ছিলো অবৈধ দখলদার!
 ভারতের শাসনক্ষমতা তখন ছিলো দিল্লীর হাতে। দিল্লীর মুঘল সম্রাটের আঞ্চলিক প্রতিনিধি ছিলেন বাংলার নবাব। অর্থাৎ নবাব স্বাধীন নয়। এখন স্বাধীন মুখ্যমন্ত্রী বললে শুনতে যেমন লাগবে তেমনই ছিলো বিষয়টা।
আবার নবাব হওয়ায় জন্যে দিল্লির যে পার্মিশন লাগত তাও সিরাজের ছিলো না। আলীবর্দীর ছিলো। কিন্তু সিরাজের ছিলো না। অর্থাৎ সিরাজ একজন অবৈধ দখলদার ছিলো মাত্র। বৈধ অনুমতি তার ছিলো না। সে না ছিলো স্বাধীন আর না ছিলো বৈধ নবাব।
৩- সিরাজ একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলো!
সঠিক তথ্য – এই কুকর্মটা করেছে ব্রিটিশ আমলের কিছু নাট্যকার! নাটকের নায়ক হিসাবে ব্রিটিশ বিরোধী তেমন কোনো যুৎসই ঐতিহাসিক চরিত্র না পেয়ে সিরাজকেই নাটকের হিরো বানিয়ে দিয়েছিলো।  আর হিরো কখনো প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে পারে? ফলে আগাপাশতলা অত্যাচারী সিরাজ হয়ে গেলো একজন প্রজাবৎসল শাসক।  
আর আসল সিরাজ কেমন ছিলো? সরাসরি বিদ্যাসাগরের একটা উদ্ধৃতিই তুলে দেওয়া যাক –  
//”নবাব সিরাজদৌলা সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘সিরাজ উদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কৰ্ম্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্ৰিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা, প্ৰতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্ৰায় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই” //
 (বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম অধ্যায়, শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)
এছাড়া সিরাজের সমকালীন ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন‚ পলাশীর যুদ্ধ কাব্যে নবীনচন্দ্র বা স্যামুয়েল চার্লস তার Bengal in 1756-1757 তে সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে কিভাবে সিরাজের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। ইচ্ছা থাকলে যে কেউ এগুলো পড়ে দেখতে পারেন।
পলাশীর যুদ্ধ কাব্যের প্রথম সর্গে নবীনচন্দ্র স্পষ্ট লিখেছেন –
// যবনের অত্যাচার করি দরশন,
বিমল হৃদয় পাছে হয় কলুষিত,
ভয়েতে নক্ষত্র-মালা লুকায়ে বদন,
নীরবে ভাবিছে মেঘে হয়ে আচ্ছাদিত//
এছাড়াও সেই আমলে লেখা ‘ইব্রাত-ই-আরবাব-ই-বসর’ গ্রন্থে সিরাজকে ‘লঘুচিত্ত, একগুঁয়ে, বদ-মেজাজি, অধীর ও মুখ খারাপ এবং কাউকে রেহাই দিয়ে কথা বলত না’ বলা হয়েছে।
‘সিয়ার উল মুতাখখিরিন’-এ বলা হয়েছে : “সিরাজ কর্কশ ও অভদ্র কথাবার্তা এবং সরকারি কর্মচারিদের ঠাট্টা ও উপহাস করায় সকলের মনে ক্ষোভ ছিল।” 
৪ – সিরাজ একজন কমপ্লিট ফ্যামিলি পার্সন ছিলো।
সঠিক তথ্য – এই মিথের জন্মও বিভিন্ন সিনেমা – নাটক থেকে।  যেখানে হতচ্ছাড়াকে একজন আদর্শ নাতি‚ আদর্শ স্বামী‚ আদর্শ বাবা সহ দুনিয়ার যা কিছু আদর্শ আছে সব বানানো হয়েছে। 
অথচ সিরাজ একবার ক্ষমতা দখলের জন্যে নিজের দাদুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। বিহার থেকে সেনাসামন্ত নিয়ে মুর্শিদাবাদ এসে পড়ছিলো দাদুকে মেরে সিংহাসন নেওয়ার জন্য। যে দাদু কিনা পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিরাজকে অন্ধভাবে ভালাবাসত। অনেক কষ্টে আলীবর্দী সেই ঝামেলা সামলায়।
এছাড়া সিরাজের প্রথম সন্তান জন্মিয়েছিল তার বিয়ের (শাদীর) আগেই! সিরাজের চ্যালা মোহনলালের বোন মাধবীর সাথে সিরাজের অবৈধ সম্পর্ক হয়। এবং এর ফলে উৎপন্ন ছেলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে অবিবাহিতা মাধবী সিরাজকে জোর করলে সিরাজ একটা ঘোড়ার পিঠে বাচ্চাটাকে বেঁধে ছেড়ে দেয়। তখন মোহনলাল গিয়ে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করে। আর আলীবর্দী খবর পেয়ে সিরাজের সাথে মাধবীর বিয়ে দেয়। অবশ্যই মাধবীকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার পর। 
(Source – সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে- অমলেন্দু দে)
৫ – আলিনগরের যুদ্ধ সিরাজ বাঙ্গালীর ভালোর জন্য করেছিলো।
সঠিক তথ্য – যেহেতু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেকে এখানে বাঙ্গালী সেন্টিমেন্ট বসিয়ে ফেলে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো যে ব্রিটিশদের পতনের পর সিরাজের সৈন্য কলকাতার বাঙ্গালীদের এলাকায় ঢুকে পড়ে ও প্রবল লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ব্রিটিশদের বাঙ্গালী চাকরদেরকে উপর সাঙ্ঘাতিক অত্যাচারও করে। কলকাতার যাবতীয় অট্টালিকাও সিরাজের সৈন্যরা গুড়িয়ে দিয়েছিলো সিরাজের নির্দেশ মতো! রেহাই পায়নি হতভাগ্য চাকরদেরকে বাসগৃহগুলোও।
(Source – মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়ের জীবনচরিত। পৃষ্ঠা – ৭৩-৭৪)
আগেও বলেছি। বারবার বলি পলাশীর যুদ্ধে বাঙ্গালা পরাধীন হয়নি। আমরা অলরেডী পরাধীনই ছিলাম। সেদিন আমাদের প্রভু বদল হয়েছিল মাত্র। মধ্য এশীয় প্রভুদের হাত থেকে ব্রিটিশ প্রভুদের হাতে‚ এক আব্রাহামিক প্রভুদের হাত থেকে অন্য আব্রাহামিক প্রভুদের হাতে বাঙ্গালীর হস্তান্তর হয়েছিল মাত্র। যার এক তৃতীয়াংশের স্বাধীনতা এসেছে ১৯৪৭ সালে। বাকি দুই তৃতীয়াংশ এখনো প্রাক-ব্রিটিশ প্রভুদের হাতেই থেকে গেছে। 
তাকে আবার স্বাধীন করে মহারাজা শশাঙ্ক-দেবপাল-দনুজ রায়-প্রতাপাদিত্যের তলোয়ারচর্চিত সোনার বাঙ্গালার অখণ্ড রূপ পুনঃপ্রতিষ্ঠা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। এবং আমরা তা পালন করবোই।
Souvik Dutta

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *