“আরও কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে…….”
প্রয়াণ দিবসে রইল আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার )অন্তর্গত ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে সুচিত্রা সেন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন এক স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পাবনা শহরেই তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী. যদিও তার আসল নাম রমা দাশগুপ্ত, তবে ছবিতে আসার পর রমা নাম বদলে নাম রাখা হয় – সুচিত্রা সেন.. সিনেমার ইতিহাসের এক ধ্রুবতারা.. আজ তাঁর প্রয়ান দিবসে কিছু তথ্য..
১. গ্ল্যামার জগতের নায়িকা হলেও নিজে মনে প্রানে এই জগৎ কে ঘৃণা করে এসেছেন তিনি যে কারণে ছবির সেটে আড্ডা বা বাড়ীতে ফিল্মি পার্টি এসবের পক্ষপাতী ছিলেন না কখনো. বিশেষ কয়েকজন ছাড়া তাঁর বাড়িতেও ছবির জগতের কারো প্রবেশাধিকার ছিল না.
২. উত্তম সুচিত্রা বাঙালীর সর্বকালের সেরা জুটি হলেও একটা সময়ের পর থেকে ছবির পোস্টার, টাইটেল সহ বুকলেট, রেকর্ড সবেতেই উত্তমকুমার এর নামের আগে সুচিত্রা সেনের নাম লেখা হত. পুরুষ প্রধান ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি ই প্রথম বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই ব্যাপারে. জন শ্রুতি তাঁর পারিশ্রমিক ও ছিল উত্তমকুমার এর চেয়ে বেশী.
৩. ভারতীয় ছবির দুনিয়ায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার “দাদা সাহেব ফালকে” পুরস্কার নিতে তিনি রাজী হননি.. কারণ তিনি অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন এবং জন সমক্ষে আসতে চাননি. ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তিনি ই একমাত্র শিল্পী যিনি এই পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকার করেন.
৪. ষাটের দশকে তাঁকে নাম ভূমিকায় রেখে “দেবী চৌধুরানী” ছবিটি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়. কিন্তু সুচিত্রা সেন রাজী হননি. কারণ সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম শর্ত ছিল সুচিত্রা সেনের এক্সক্লুসিভ ডেট অর্থাৎ ” দেবী চৌধুরানী” ছবির শুটিং চলাকালীন তিনি অন্য ছবিতে অভিনয় করতে পারবেন না. কিন্তু এ প্রস্তাব রাজী হননি মহানায়িকা. তিনি তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন যে যাঁরা তাকে নায়িকা বানিয়েছেন তাঁদের বঞ্চিত করে তিনি শুধুমাত্র এই ছবিতে কাজ করা সম্ভব নয়. তিনি রাজী হননি বলে ছবিটি করেননি সত্যজিৎ রায়.
৫. রাজ কপুরের ছবির অফার ও ফিরিয়ে দেন তিনি. শোনা যায় রাজ কাপুর প্রথম দিনেই দেখা হওয়ার পর সুচিত্রা সেন কে একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া উপহার দেন ও মহানায়িকার পা এর কাছে হাঁটু গেড়ে বসেন যা একেবারেই ভালো লাগেনি মহানায়িকার. পরে সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর লেখা একটি বই এ জানা যায় মহানায়িকা বলেছিলেন-” অমন মিনমিনে পুরুষ আমার ভালো লাগে না. পুরুষ হবে উজ্জ্বল এবং বলিষ্ঠ”..
৬. রোলেক্স এর ঘড়ি, কাঁচের চুড়ি, নানা ধরনের বিদেশী জুতো খুব পছন্দের ছিল মহানায়িকার. গাড়ীতে সবসময় পনেরো ষোল রকমের জুতো সাজানো থাকত তাঁর. মুড অনুযায়ী রঙ বদলে বদলে জুতো পরতেন মহানায়িকা. কাঁচের চুড়ি কিনতেন শহরের নানা দোকান থেকে কিন্তু বড় সানগ্লাসে মুখ ঢেকে যাতে কেউ চিনতে না পারে.
৭. অন্তরালে যাওয়ার পরে তাঁর মৃত্যুর এত গুজব ছড়িয়েছিল যে বিরক্ত মহানায়িকা মাঝে মাঝেই তাঁর এক পছন্দের চিত্রগ্রাহক কে রসিকতা করে বলতেন -” আমাকে শুইয়ে দে একটা সাদা চাদর চাপা দিয়ে দে আর ছবি তুলে লিখে দে বুডডি মর গিয়া… দেখবি অনেক টাকা পাবি”…
৮. শ্রীরামকৃষ্ণ পরম হংস দেব এবং মা সরদার ভক্ত মহানায়িকা কে অনেক ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ই বারবার বলতেন যে -” রমা তুমি কেন ছবিতে আর কাজ করো না তুমি কাজ করতে চাইলে বাড়ীতে পরিচালক প্রযোজকের লাইন পড়ে যাবে”.. উত্তরে স্মিত হেসে মহানায়িকা জবাব দিতেন-” ওসব আমার আর ভালো লাগে না তাছাড়া আমি ঠাকুরের আশীর্বাদ পেয়েছি যা অমৃত.. আর যে অমৃত খেয়েছে সে কি দোকানের লাল চা খেয়ে তৃপ্তি পাবে..” পুজো অর্চনা ঈশ্বরের সেবা করতে খুব ভালোবাসতেন মহানায়িকা. নিজের হাতে ফুল তুলে পুজো করতেন রোজ.
৯. সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেন পরিচালক বিমল রায় কে “মামা” বলে ডাকতেন. মহানায়িকা সেই সূত্রেই ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” বলে একটি ছবিতে অভিনয় করেন যদিও সেই ছবি কখনো মুক্তির আলো দেখেনি.
১০. বাড়ীর বিরাট ছাদে রোজ দুবেলা পাখিদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন মহানায়িকা. কাক, চড়ুই, সহ নানা পাখিদের দুবেলা নিজের খাতে দানা, খাবার দিতেন মহানায়িকা. তারাও দুবেলা উড়ে এসে বসত মহানায়িকার কাছে. জলের পাত্রে রোজ জল রেখে দিতেন তাদের জন্য. শুটিং ও কাজের চাপ থাকলেও এর ব্যতিক্রম হত না কখনো.
১১. ঋত্বিক ঘটক মানসিক হসপিটাল এ ভর্তি থাকার সময় তাঁর ভরন পোষন এবং খাওয়া দাওয়া চিকিৎসা র ভার নিয়েছিলেন মহানায়িকা. নিজের হাতে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ার এ করে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসতেন মহানায়িকা. এছাড়া জহর রায়ের অন্যতম প্রিয় বন্ধু ছিলেন মহানায়িকা. জহর রায়কে “চার্লি” বলে ডাকতেন তিনি. জহর রায় প্রয়াত হওয়ার পরে নিজে গাড়ী চালিয়ে গিয়ে জহর রায়ের মরদেহে মাল্যদান করে জহর রায়ের কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন-” তুমি চলে গেলে চার্লি..??”
১২. ফ্যাশন আইকন ও বাঙালীর হার্টথ্রব সুচিত্রা সেন অভিনয় সহ নানা ভাবে গ্রূম করেন মহানায়ক উত্তম কুমারকে. যে কারণে নানা লেখায় মহানায়ক বারবার লিখেছেন- ” আমার উত্তমকুমার হওয়া হত না রমা না থাকলে. ও আমাকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহস দিয়ে আজকের আমার আমি কে গড়ে তুলেছে. অভিনয়ের ক্ষেত্রেও আমি রমা আর সাবু কে ভয় পাই.. কারণ ওরা যেকোন ছোট্ট সিনেও অভিনয় কে অন্য মাত্রা দিয়ে আমাকে মেরে বেরিয়ে যেতে পারে. তাই ওদের সঙ্গে কাজ করার সময় খুব সতর্ক থাকি..মহানায়ক এর আত্মজীবনী তেও সুচিত্রা প্রসঙ্গে নানা কথা লিখে গেছেন মহানায়ক. যে লাইন গুলো জীবনের শ্রদ্ধার্ঘ্য.. ছবির সংলাপ নয়…
১৩. প্রিয় বন্ধু গোপাল কৃষ্ণ রায় একবার মহানায়িকার ঘরে একটি সাধারণ তক্তপোষ দেখে মহানায়িকা কে প্রশ্ন করেন যে এত বিলাসবহুল আসবাব এর মাঝে এই বেমানান সাধারণ তক্তপোষ কেন?? মহানায়িকা বলেন-” ওটা আমার শেষ যাত্রার জন্য রেখেছি.. জন্মেছি শক্ত মাটিতে. মরার পরে শক্ত স্প্রিং এর খাটে শুয়ে শ্মশানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই ওটা আনিয়ে রেখেছি..” শুনে বিস্মিত হন গোপাল কৃষ্ণ রায়..
১৪. ঘরোয়া আড্ডায় বিদেশী সিগারেট সহযোগে নানারকম মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন মহানায়িকা. তবে আড্ডায় সিনেমার গল্প একেবারে না পসন্দ ছিল মহানায়িকার. সিনেমার কথা উঠলেই মহানায়িকা বলতেন-” আর ভালো লাগে না বাপু তোমাদের রাতদিন খালি সিনেমা আর সিনেমা তার চেয়ে ভূতের গল্প বলো..”!
মহানায়িকা কে নিয়ে লিখতে বসলে এই পোস্ট শেষ হবে না.. আজ প্রয়ান দিবসে একজন সামান্য ভক্তের তরফ থেকে বাঙালীর সর্বকালের সেরা মহানায়িকা কে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম..