সেকন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনের সময়ের গল্প বলি।
সেপ্টেম্বর মাসের সাত তারিখ, ১৯৬৮ সন। আমেরিকার আটলান্টাতে মিস আমেরিকা সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলছে। ঐদিন নিউ ইয়র্কের রেডিক্যাল নারীবাদীদের একটা সংগঠনের দুইশ কর্মী সমর্থক জড়ো হয়েছে সেখানে। যে হলটাতে সুন্দরী প্রতিযোগিতা হচ্ছে সেই হলের সামনে ওরা নানারকম ব্যানার ফেস্টুন হাতে নিয়ে নারীমুক্তির স্লোগান দিচ্ছে আর মিছিল করে বেড়াচ্ছে। সেখানে আবার একটা ডাস্টবিন পেতেছে ওরা- ডাস্টবিনটার গায়ে লেখা ‘Freedom Trash Can”। নারীরা ঘরে ঘুরে শ্লোগান দিচ্ছে আর সেই ডাস্টবিনটার মধ্যে একটা দুইটা করে এটা সেটা ফেলছে। কি ফেলছে? ব্রা, চুলের স্প্রে, লিপস্টিক, মুখে মাখার নানারকম রঙ, নকল চোখের পাপড়ি, করসেট এইসব।
এই কর্মসূচীটা সাধারণভাবে Bra Burning Event নামে পরিচিত, কিন্তু আসলে সেদিন ঐখানে কোন ব্রা পোড়ানো হয়নি। আর কর্মসূচীটা শুধু হলের বাইরেই ছিল না। উপস্থিত নারীবাদী কর্মীদেরকে হলের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেও দুইজন নারী টিকেট কেটে হলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। অনুষ্ঠানের যেই পর্যায়ে এর আগের বছরের মিস আমেরিকা বিজয়ী তাঁর বিদায়ই বক্তৃতা ঠিক সেই সময়ই ঐ দুইজন বিছানার চাদরের আকৃতির একটা বিশাল ব্যানার বের করে গয়লারই থেকে উঁচু করে ধরে নারীমুক্তির পক্ষে নানারকম শ্লোগান দিতে থাকেন। বেশিক্ষণ ওরা সেখানে থাকতে পারেননি, পুলিশ এসে ওদেরকে বের করে দেয়।
প্যারিসের ঘটনা। ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখ। চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, গায়ক, দার্শনিক, অভিনেত্রী এইরকম ৩৪৩ জন্য বিশিষ্ট নারী একটা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করলেন প্যারিসের একটা কাগজে। সেইখানে ওরা বললেন, “ফ্রান্সে প্রতিবছর দশ লক্ষ নারী গর্ভপাত ঘটায়। আমি ঘোষণা করছি যে আমিও ওদের একজন, আমি আরও ঘোষণা করছি যে আমিও গর্ভপাত করিয়েছি। আমরা প্রকাশ্যে গর্ভপাতের অধিকার দাবী করছি এবং প্রকাশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অধিকার দাবী করছি”। মনে রাখবেন সেই সময় ফ্রান্সের আইনে গর্ভপাত একটা গুরুতর অপরাধ।
গ্লোরিয়া স্টেইনেম এর কথা বলি। গ্লোরিয়া স্টেইনেম আমেরিকার নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি নিজে প্লেবয় বানি সেজে নারীমুক্তি আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়েছেন। প্লেবয় ক্লাবে ওয়েইট্রেসদেরকে একটা খরগোসের মত পোশাক পরানো হতো। দুই পা পুরো উম্মুক্ত, কাঁধ আর বুকের দিকে অনেকটা উম্মুক্ত আর মাথার ওখানে দুইটা লম্বা কান লাগানো আর পায়ে হাই হিল। এই পোশাক পরে নারীরা পুরুষ গ্রাহকদের খাবার পানীয় এইসব পরিবেশন করতো। গ্লোরিয়া স্টেইনেমএর কথা হলো এইটা হচ্ছে পুরুষের বিনোদনের জন্যে নারী দেহের ব্যাবহার। এইটার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে তিনি নিজে এই পোশাক পরে মিছিলে গেছেন।
এইরকম আরও ঘটনা আছে, যেগুলি এমনিতে দেখলে আপনার মনে হবে একটু বাড়াবাড়ি বা যেন প্রতিবাদের প্রচলিত শোভন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি আপনাদেরকে বলতে পারি, এইসব কর্মসূচীর প্রতিটাই ছিল সৃজনশীল কর্মসূচী এবং ঠিকমতো সংগঠিত এইরকম একটা সৃজনশীল কর্মসূচী আপনার আন্দোলনের বক্তব্য বা দাবীকে ছড়িয়ে দিতে একটা সাধারণ কনভেনশনাল কর্মসূচীর চেয়ে হাজার গুণ বেশী কার্যকর হতে পারে।
এই কথাগুলি বলার একটা কারণ আছে।
সম্প্রতি রাজশাহীতে একদল পিতৃতান্ত্রিক মূর্খ গুণ্ডা একজন নারীকে হেনস্তা করেছে কারণ সেই নারীটি প্রকাশ্যে সিগারেট খাচ্ছিলেন। সেই ঘটনার প্রতিবাদে অনেকেই ফেসবুকে সিগারেট হাতে ফটো পোষ্ট করেছেন। এই সিগারেট হাতে ফটো দেওয়ার ব্যাপারটা অনেকে পছন্দ করেননি। ঠিক আছে আপনি সেটা পছন্দ করছেন না, না করেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার বড় লড়াইয়ে এইরকম ছোট একটা সৃজনশীল কর্মসূচী কখনো কখনো একটা বড় অভিঘাত তৈরি করতে পারে। আমার তো মনে হয় একদল নারী যদি রাজশাহীর সেই জায়গাটাতে একসাথে জড়ো হয়ে ধুমসে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া উড়াতেন- সেইটা একটা দারুণ কর্মসূচী হতে পারতো।
লেখাঃImtiaz Mahmood