স্বর্গ-নরক অলীক জিনিস—ওসব দিয়ে জীবন চলে না। চলে কি?

Uncategorized

ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি
প্রবীর বিকাশ সরকার

ধর্ম সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই, ধারণাও নেই। এমনকি, আগ্রহও নেই। কারণ ধর্ম না-পড়া ও না-জানার মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়েছি। মা অবশ্য ধর্মকর্ম পালন করেছে আজীবন, কিন্তু আমার পিতা করেনি। কোনোদিন কোনো মন্দিরে বা কোনো পুজোয় বাবাকে যেতে দেখিনি। এমনকি, রামনামও তার মুখে শুনেছি বলে ভুলেও মনে পড়ে না।

ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে মন্দিরে গিয়েছি, পুজোয় গিয়েছি নমো নমো করেছি। আমার মা ও বাবা কেউই সংস্কৃতি ভাষা জানত না। সুতরাং আমিও জানি না। স্কুলে যদিও হিন্দুধর্ম পড়েছি, সংস্কৃতি ভাষা ও আরবি ভাষাও পড়েছি। সেগুলো নেহায়াত পড়ার জন্য পড়া, মুখস্থ করেছি পরীক্ষা দিয়েছি, ভালো নম্বরই পেয়েছি। মহাভারত, রামায়ণ এবং পুরাণ পাঠ করেছি গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করে ওই পর্যন্তই।

কলেজে ওঠে ধর্মবিষয়ক কোনো বিষয় ছিল না। ধর্মপালন বলতে পুজোর আয়োজনে সহযোগিতা করা, মন্ত্রপড়া, অঞ্জলি দেয়া, প্রসাদ খাওয়া ও বিতরণ আর আনন্দকরা এই ছিল আমার ২৫ বছরের বাংলাদেশের জীবনে ধর্মপালন বলতে যা করেছি।

কিন্তু আমি যে বিষয়টি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে এসেছি, সেটা হল হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের সংস্কৃতি। দুটো ধর্মবিষয়ক বেশকিছু গ্রন্থ পাঠ করেছি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আর অন্য ধর্ম সম্পর্কে আমি জানার কখনো চেষ্টা করিনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, আজিবিক, শিখ ইত্যাদি ধর্মগুলো ভারতীয়, কিন্তু ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম ভারতের বাইরের ধর্ম। কিন্তু সমগ্র বাংলা অঞ্চলের কথা যদি ধরি, তাহলে দেখি বাংলার মধ্যে কোনোকালেই কোনো ধর্ম জন্মলাভ করেনি। সবগুলো ধর্মই বাংলার বাইরে থেকে আগত। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ধর্মপ্রচারের নিমিত্তে এই ধর্মগুলো এসেছে। বাংলার চৌহদ্দির মধ্যে প্রথম যে ধর্ম এসেছে সেটা বৌদ্ধধর্ম। খননকৃত বিহারগুলো সেটাই প্রমাণ করে। দেড় হাজার বছরের কোনো হিন্দুমন্দির বা তার চিহ্ন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

বাংলার প্রাচীন হিন্দুরাও বহিরাগত, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, কাশ্মির-পাঞ্জাবের ব্রাহ্মণরা এই অঞ্চলে এসে হিন্দুধর্ম প্রচার করেছেন। প্রকৃত অর্থে, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ যেসকল ধর্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলে এসেছে সেগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে আসেনি, আসতে আসতে এরা বদলে গেছে। এইসব নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক বিদ্যমান এবং আরও বহু বছর এই বিতর্ক থাকবে। থাকুক এতে আমার কিছু যায় আসে না, ধর্মগুলোরও কিছু যায় আসে না।

আরও একটি ব্যাপার আছে, ধর্মগুলো যে অঞ্চলে জন্মলাভ করেছে সে অঞ্চলের জলবায়ু, আবহাওয়া ও মানুষের চরিত্র অনুযায়ী হয়েছে। যার সঙ্গে ঝড়জলবন্যায় দিকভ্রান্ত, অস্থির ও অশিষ্ট বাঙালি চরিত্রের খাপ খায়নি কোনোদিনই। বহিরাগত কোনো শাসকই বাংলা অঞ্চলকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মুঘলরা পারেনি, আফগানরা পারেনি, ইরানিরা পারেনি, ব্রিটিশরাও পারেনি। বারংবার মার খেতে হয়েছে। সুতরাং বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতি কোনোকালেই আমাদের আপন হয়নি। নানামত, নানাপথে বিভ্রান্তই হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কোনো ধর্মই বাঙালি সমাজে শান্তি আনতে পারেনি, ব্যতিক্রম পাল শাসনামল। তবে শাসকরা বাঙালি ছিল না। তাছাড়া প্রতিটি ধর্ম নানা মত ও শ্রেণীতে বিভক্ত। অসহিষ্ণুতার জন্ম স্বধর্ম থেকেই।

এসএসসির ছাত্র পর্যন্ত আমার মনে কতগুলো ভয় ছিল যেমন, খারাপ কাজ করলে, দেবদেবীকে না মানলে, পুজোয় না গেলে, চুরি করলে, মিথ্যেকথা বললে, মেয়েদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে, বাবা-মাকে না মানলে, মদ, গাঁজা টানলে পাপ হবে এবং পাপের শাস্তি হল মৃত্যুর পর নরকে যেতে হবে। নরক কী এবং কোথায় একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা আমাকে একটা বই দিয়েছিল তাতে দেখলাম স্বর্গ ও নরকের রঙিন ছবি মুদ্রিত। শুধু তাই নয়, শিশু থেকে বুড়ো হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের সাইকল বা বৃত্তচিত্রও ওই বইতে দেখেছিলাম।

কলেজে ওঠার পর নাবালকত্বটা সাবালকত্বের দিকে ধাবিত হতে থাকল দ্রুত। পৃথিবীটাকে রঙিন এবং কৌতূহলকর মনে হতে লাগল। নানা বিষয়কে জানার, নানা স্বাদকে আস্বাদিত করার, নানা অপকর্ম করে দেখার চ্যালেন্জকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। একদিন যখন সিগারেটের নিষিদ্ধ স্বাদ নিলাম, তরল পানীয়তে আকণ্ঠ নেশাও করলাম, গাঁজার কলকি ফাটিয়ে ফেললাম—তখন মাঝে মাঝে মহাদেবকে দেখতে লাগলাম স্বপ্নের মধ্যে। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, যৌবনের কোনো ধর্ম নেই। ৫০ এর পর ধর্মটর্ম করবে। না করলেও চলবে। তবে পুঁথিগত ধর্ম অনুসরণ না করে নিজের ভেতরের বাস্তব সত্যকে অনুভব করে জীবন পরিচালনা করলেই তুমি একদিন মোক্ষলাভ করবে। তিনি আরও আমাকে বললেন, যা ইচ্ছে তাই করবে, কিন্তু ভুলেও মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে না। সচেতন থাকবে। প্রতিটি করনীয় দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যকে যুক্তির দ্বারা হিসেব করে নেবে। যুক্তি না মানাটাই হবে অপরাধ। অপরাধের শাস্তি তুমিই পাবে, আর কেউ পাবে না। প্রচলিত ধর্ম পালন না করলেও তুমি নরকে যাবে না। পালন করলেও স্বর্গে যাবে না। কারণ, স্বর্গ ও  নরক বলতে কিছু নেই। মাটির নিচে শুধু জল আর জল। আকাশের ওপরে শুধুই শূন্যতা। স্বর্গ ও নরক কল্পনা মাত্র।

এই পর্যন্ত বলে তিনি অট্টহাসি দিয়ে হিমালয়ের কুয়াশায় মিলিয়ে গেলেন। আমাকে আর পায় কে! অনুমোদন তো পেয়েই গেলাম। লে বাবা! যা ইচ্ছে করে তাই কর, তবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাসনে! দেশে থাকতে যা ইচ্ছে করেছে তাই করেছি। জাপানে এসেও যা ইচ্ছে করছি এখনো। কিন্তু আমি কখনোই মাত্রা ছাড়িয়ে যাইনি।

জাপানে এসে আমি তো অবাক আর অবাক! কোনো জাপানি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন না, তোমার ধর্ম কী? তোমার বাবা কী করেন? তোমার মা কী করেন? তোমার দাদাঠাকুর কী করতেন? শুধু জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী করো?

আমি বিয়ে করলাম জাপানি মেয়েকে আন্তর্জাতিক নিয়মে। ইন্টারন্যাশনাল মেরেজ। কনে বৌদ্ধ আমি বাবা-মার ধর্ম অনুযায়ী হিন্দু এবং নমশূদ্র। বিয়ের একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান হল, কনে, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিয়ার, মদ, কাচা মাছ, মাংশ, সবজি, শামুক, ঝিনুক খেয়ে মাতাল হয়ে গেলাম। হয়ে গেলাম অর্ধেক জাপানি একদিনেই!

একদিন রাতে স্বপ্নে দেখা দিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বললেন, কর্মই ধর্ম। তোমার মধ্যে বিশ্বজনীনতা থাকলে তুমিই ঈশ্বর। এগিয়ে চলো। লড়াই করো। তোমার ইচ্ছাপূরণ তোমাকেই করতে হবে। ভুল করলে ভুল থেকে শিখবে, যেমন জাপানিরা ভুল করলে সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঙ্গেসঙ্গে।

কী আশ্চর্য ব্যাপার! শ্রীকৃষ্ণ এ কি বললেন! ধর্মটর্ম কিছুই পালনের কথা বললেন না! আবর-জাবর গিলছি, খাচ্ছি এইসব ব্যাপারেও কিছু বললেন  না! ক্রমশ দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম জাপানি সমাজের গভীরে প্রবেশ করে যে, কর্মই ধর্ম। মন্দিরে যাওয়া একটা সংস্কৃতি মাত্র। স্বর্গ-নরক বলতেও কিছু নেই। তবে ভালো ও খারাপ কাজের জন্য স্বর্গীয় ও নারকীয় অনুভব আছে। জাপানিরা যা করছেন প্রতিদিন, তা হল কাজ আর কাজ। তাদের কাছে ঈশ্বর, দেব, দেবী হচ্ছেন কাজ আর টাকা। তাদের প্রধান আরাধনা হচ্ছে কর্ম আর প্যাশন হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করা। নান্দনিকতাকে উপভোগ করা। তাতে মন ও দেহ ভালো থাকে। এই জন্যই তারা ধর্মীয় সংস্কৃতির এক শান্তিময় বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে দেখা যায় না। তাদের কথা আগে কাজ, তারপর ধর্ম।

আরে! এ তো দেখছি আমার জন্মদাতা পিতার চিন্তা ও আচার-আচরণের সঙ্গে শতভাগ মিল জাপানিদের! বাবা কি তবে পূর্বজন্মে জাপানি ছিল? একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার ধর্ম কী বাবা? রেগে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কলম আর খাতা এনে বলল, এই দুটোই আমার ধর্ম! শুনে তো টাসকি খেয়ে গেলাম!

জাপানিদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, ধর্মকে ঘিরে যেসকল সংস্কৃতি আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা ঐতিহ্য। ঐতিহ্যহীন মানুষ বিভ্রান্ত হয়। কর্মও করো, ধর্মীয় সংস্কৃতিও পালন করো, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-ক্রীড়া সবই করো তবে একখানে গুলিয়ে ফেলো না। তাহলে মরবে। আমরা কি তাহলে মরতে চলেছি? সেই লক্ষণ তো একেবারেই সুস্পষ্ট। কে রক্ষা করবে আমাদেরকে?

জাপানিদের মতো “ধর্মেও থাকা, জিরাফেও থাকা” সম্ভবপর নয় কেন? সেটাই তো বাস্তবতা মানবসভ্যতাকে বোঝার জন্য। নয় কি? স্বর্গ আর নরকের কথা ভেবে উগ্র, উন্মাদ, জল্লাদ হয়ে যাওয়া কি ঠিক? এতে শান্তি, সুখ ও আনন্দ সব নষ্ট হচ্ছে না?

মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, যতখানি পারা যায় আনন্দে থাকাইটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং ধর্মেও থাকো, জিরাফেও থাকো। অহেতুক স্বর্গ-নরক নিয়ে লেফট-রাইট করে মূল্যবান সময় নষ্ট করো না। স্বর্গ-নরক অলীক জিনিস—ওসব দিয়ে জীবন চলে না। চলে কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *