স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটি বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস চার সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে। মহাভারতে বঙ্গ শব্দ শব্দের উপস্থিতি থেকেও বুঝতে পারা যায় যে, বাংলা অতি প্রাচীন এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রাচীন বাংলা:
একদল গবেষক দাবি করেন যে, মানুষ ৬০,০০০ বছর আগে চীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছিল। অন্য আরেকটি দলের মতে; ১০০,০০০ বছর আগে এখানে একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। এক সময় বাংলায় ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েডদের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং তাদেরই মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের নাম ছিল বঙ্গ।
৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), মহাস্থান এবং ময়নামতীর মতো উন্নত শহর গড়ে উঠে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান শহরগুলো সমুদ্রতীরের পরিবর্তে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠতে দেখা যায়।[১৭] মহাস্থান থেকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম লেখা একটি পাথরের শিলালিপি আবিস্কৃত হয় যা থেকে বোঝা যায় যে, স্থানটি মৌর্য সাম্রাজোর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল।
নন্দ সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য হলো প্রাচীন বাংলার সাম্রাজ্য।
ধ্রুপদী যুগ:
ষষ্ঠ শতকের পরে গৌড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে পাল সাম্রাজ্য, সেন রাজবংশ, দেব রাজত্ব ইত্যাদি রাজত্ব গড়ে ওঠে। অবশেষে বাংলার মাহমুদ শাহী সুলতান ফিরোজ শাহের আক্রমণে দেব রাজবংশের পতন হয়।
মধ্যযুগ এবং ইসলামী শাসন:
সপ্তম থেকে আরব, পারসীয়, আফগান, মুঘল প্রভৃতি সুফি সাধক ও অভিযানকারী মুসলিমরা বাংলায় বিজয় লাভ করে এবং তারা বাংলা অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিল।
বখতিয়ার খিলজী ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন। তিনি বিহারের পাল রাজবংশের অবশিষ্টাংশের পতন ঘটিয়ে বিহার দখল করেন। এরপর বাংলা আক্রমণ করে বাংলার একাংশ দখল করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে মামলুক শাসন, মাহমুদ শাহী রাজবংশ, ইলিয়াস শাহী রাজবংশ বাংলায় রাজত্ব করেন। তারপর রাজা গণেশ বাংলার ক্ষমতায় আসেন। রাজা গণেশের পূর্বে বাংলার হিন্দুগণ মুসলমান শাসকদের প্রভাবে ব্যাপক মাত্রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিলেন। এই ধর্মান্তর রোধ করার জন্য তিনি এই নতুন সত্যপীর প্রথার প্রচলন করেন। পরবর্তীতে আবার ইলিয়াস শাহী রাজবংশ বাংলার ক্ষমতায় আসেন। তারপর হোসেন শাহী রাজবংশ, সূরী রাজবংশ, কররানী রাজবংশ বাংলায় রাজত্ব করেন।
মুঘল যুগ:
বাংলার একাংশ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের পরাজয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মুঘল আধিপত্য আরম্ভ হয়। এসময় ইসলাম খান, মীর জুমলা, শায়েস্তা খান বাংলা শাসন করে।
বাংলার নবাব:
মুর্শিদকুলী খান ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর সুবাহ বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুর্শিদকুলী খানের পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবাব হন। এরপর নবাব আলীবর্দী খানের পরে সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন। সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন। ফলে বাংলার নবাবী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
ঔপনিবেশিক শাসন:
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে আবার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হয়, আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়।
পাকিস্তান আমল:
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যথা ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে ওঠে যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বাংলা নিয়ে যা বর্তমানের বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামগ্রিক বিষয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা জনরোষ গড়ে উঠতে থাকে।
ভাষা আন্দোলন:
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করে, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়।
স্বাধীনতার প্রস্তুতি:
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরবর্তীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ই মার্চ এর ভাষণে, পাকিস্তানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একটি আসন্ন যুদ্ধের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করা হয়, এবং এ ভাষণের বিখ্যাত উক্তি ছিল: “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।”
স্বাধীনতার যুদ্ধ:
২৬ মার্চের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সামরিক অভিযান শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাজনৈতিক নেতারা বহুবিভক্ত হয়ে যান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে, শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাক্ষরিত নোট প্রেরণ করেন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
সামরিক উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ১১ জন কমান্ডারের অধীনে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। মেহেরপুর সরকার কর্তৃক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ বেশিরভাগ অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, যা ভারত কর্তৃক সমর্থিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলার মুক্তি বাহিনী এর মধ্যে যুদ্ধের সময় আনুমানিক এক কোটি বাঙালী, প্রধানত হিন্দু, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেয়। ভারত বাংলাদেশকে নানাভাবে সাহায্য করে। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশীদের পক্ষে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুই সপ্তাহের একটি সংক্ষিপ্ত এবং ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বিজয় অর্জন করে, হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
সদ্য জনম্ নেওয়া যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলতে থাকে। আবার হয়ে উঠতে থাকে উঠে শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা।