রাধাগোবিন্দ চন্দ্র, ভারতীয় উপমহাদেশের সফলতম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন। তিনি উপমহাদেশের পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। তার জন্ম ১৬ই জুলাই,১৮৭৮ সালে, তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে তথা বর্তমান বাংলাদেশে।
তার বাবা গোরাচাঁদ স্থানীয় একজন ডাক্তারের সহকারী ছিলেন, আর মা পদ্মামুখ ছিলেন একজন গৃহিণী। যশোর বকচর পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে রাধাগোবিন্দ, যশোর জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিলনা। বরং রাতের আকাশের প্রতি আকর্ষন ছিল বেশি। পড়াশোনায় অমনোযোগের কারণে তিন-তিন বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রথাগত পড়াশুনার প্রতি অনীহা থাকলেও তাঁর পরবর্তী জীবনের কৃতিত্ব বিস্ময়কর। ইংরেজী, ফারসী ও গণিতে তাঁর ভাল দখল ছিল। ছোট বেলা থেকে তাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল মাতুলালয়ের পারিবারিক লাইব্রেরি।

১৮৯৯ সালে তার বয়স যখন মাত্র ২১ বছর তখন তার সাথে মুর্শিদাবাদের গোবিন্দ মোহিনীর বিয়ে হয়। তখন মোহিনীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। বিয়ের পর রাধাগোবিন্দ শেষবারের মত মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষায় অংশ নেন এবং সেবারও অকৃতকার্য হন। বারবার অকৃতকার্য হয়ে তিনি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি যশোর কালেক্টরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকুরি পান। এসময় তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫ টাকা। এ থেকে পরে তিনি ট্রেজারি ক্লার্ক ও কোষাধ্যক্ষের পদে প্রমোশন পান। অবসর নেবার সময় তার মাসিক বেতন ছিল ১৭৫ টাকা।সংসার জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক, ছেলের নাম কাল ও মেয়ের নাম বর্ষা।
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাঃ
ছোটবেলা থেকেই রাধা গোবিন্দ আকাশের তারা সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন তখন তাদের পাঠ্যবই ছিল চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ। এই গ্রন্থে অক্ষয়কুমার দত্ত রচিত একটি প্রবন্ধ ছিল যার নাম “ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড”। এই প্রবন্ধ পড়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মিট মিট তারা শোভিত ধোঁয়াটে আকাশ গঙ্গা দেখে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ব্রতী হন। এ সময় তাঁর মনে ব্রহ্মান্ড ও এর সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। এ ব্যাপারে তিনি তার আত্মজীবনীমূলক পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন, “অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।”
১০ বছর বয়সে, যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি তারা দেখা শুরু করেন। বকচরের একতলা বাড়ির ছাদ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি আকাশ দেখতেন। কিন্তু কোন উপযুক্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শিক্ষা না থাকায় প্রথমদিকে তাকে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ১৪ বছর বয়সে তিনি আকাশের তারা চেনার ব্যাপারে সিদ্ধ হয়ে উঠেন। এই সময় যশোর শহরের উকিল কালীনাথ মুখোপাধ্যায় তাকে সহায়তা করেন।
খালি চোখে হ্যালির ধূমকেতুর অনন্য বর্ণনাঃরাধাগোবিন্দ ১৯০০ সালে যশোর কালেক্টরেট অফিসে মুদ্রা পরীক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি ১৯১০ সালে আগত হ্যালীর ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেন একটি সাধারণ বাইনোকুলার দিয়ে। হ্যালীর ধূমকেতুকে দুই মাস পর্যবেক্ষণ করে পর্যবেক্ষণলব্ধ উপাত্ত ধারাবাহিকভাবে একটি বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। পরে এই নিয়ে লিখলেন একাধিক প্রবন্ধ। তার একটি প্রবন্ধ ” The Hindu” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ সালের জুন মাসে তিনি নোভা (NOVA) নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। রাধাগোবিন্দ চন্দ্রই এশিয়ার সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিদ যিনি নোভা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল হার্ভার্ড কলেজ মান মন্দিরের পরিচালক ডঃ এডওয়ার্ড পিকারিং এর কাছে পাঠান। ডঃ পিকারিং রাধাগোবিন্দের পর্যবেক্ষণের মূল্য উপলব্ধি করে তাঁকে আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভারস (AAVSO)-এর সদস্য করে নেন। ১৯২৬ সালে তাঁর পর্যবেক্ষণে সহায়তার উদ্দেশ্যে হার্ভার্ড থেকে যশোরে তাঁর গ্রামে একটি ৬ ইঞ্চি প্রতিসরণ দুরবিন পাঠানো হয়। বর্তমানে এই দুরবিনটি দক্ষিণ ভারতের কাভালুর মানমন্দিরে রাধাগোবিন্দের স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে রক্ষিত আছে।
দুরবিন সংগ্রহঃ
শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাকে দূরবীন কেনার পরামর্শ দেন। ১৯১২ সালের দিকে রাধাগোবিন্দ তাঁর বেতনের টাকা ও খানিকটা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি দুরবিন সংগ্রহ করেন। এটি ৩ ইঞ্চি ব্যাসের একটি প্রতিসরণ দুরবিন ছিল। ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুরবিনটি ইংল্যান্ডের F. Bernard থেকে মেসার্স কক্স সিপিং এজেন্সি লিমিটেড এর মাধ্যমে রাগাগোবিন্দের কাছে আসে। রাধাগোবিন্দকে খুব হিসেব করে চলতে হত। সাংসারিক খরচের দ্বায়িত্ব থেকে আকাশ চর্চায় যা ব্যয় হত তা তিনি লিখে রাখতেন। সম্পূর্ণ দুরবিনটি দাম পড়েছিল ১৬০টাকা ১০ আনা ৬ পায়সা । এই হিসেবটি তাঁর খাতায় লেখা ছিল। প্রথমে মূল দুরবিনটির টিউব ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি। পরে তিনি আরও ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স ব্রহহার্স্ট এণ্ড ক্লার্কসন থেকে পিতলের টিউব আনিয়ে নেন এবং দুরবিনটির উন্নতি সাধন করেন। রাধাগোবিন্দের নথিপত্রে তাঁর নিজের হাতের লেখায় তিনি লিখে গিয়েছেন: “সন ১৩১৯, আশ্বিন মাসে দুরবিন আসার পরে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নক্ষত্রবিদ্যা অনুশীলনের ৪র্থ পর্ব আরম্ভ। এই সময়ে তিনি কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভগোলচিত্রম’ ও ‘তারা’ পুস্তকের সাহায্যে এটা-ওটা করিয়া যুগল নক্ষত্র, নক্ষত্র-পুঞ্চ নীহারিকা, শনি, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহ দেখিতেন। পরে জগদানন্দ রায়ের উপদেশ মত স্টার অ্যাটলাস এবং ওয়েব’স সিলেসিয়াল অবজেক্ট ক্রয় করিয়া যথারীতি গগন পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহার কার্য্য বেশীদূর অগ্রসর হয় নাই। তবে তিনি এই সময়ে গগনের সমস্তরাশি নক্ষত্র ও যাবতীয় তারা চিনিয়া লইয়াছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট তারায় দুরবিন স্থাপনা করিতে পারিতেন।”
নোভা অ্যাকুইলা-৩ আবিষ্কারঃ
জুন ৭, ১৯১৮ সালে তিনি আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের মানচিত্রে ছিল না। তিনি তার এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান এবং এভাবেই নোভা অ্যাকুইলা-৩, ১৯১৮ আবিস্কৃত হয়। পরে তাকে আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার -(AAVSO) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যে তিনি ৩৭২১৫টি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য আভসো (AAVSO)কে প্রদান করেন। তার এই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর তালিকাভুক্ত হন।
স্বীকৃতিঃ রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের অধিকাংশ অবদান ছিল বিষম তারার ওপর। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মানমন্দির, ব্রিটিশ অ্যাষ্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এবং ফ্রান্সের লিওঁ মানমন্দিরে নিয়মিত পাঠাতেন।১৯২৬ সালে হাভার্ড মানমন্দির থেকে তাকে একটি ছয় ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীন পাঠানো হয়। দূরবীনের সঙ্গে হাভার্ড মানমন্দিরের পরিচালক হ্যারলো শ্যাপলির লেখা চিঠি – “বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যে সব পর্যবেক্ষন মূলক তথ্য পেয়ে থাকি তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।”। ১৯২৮ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে সম্মানসূচক ‘Officer d’Academic’ উপাধি ও পদক প্রদান করেন।
দেশত্যাগঃ বাংলাদেশে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পরে পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টির কিছুকাল পর সপরিবারে তিনি ভারতে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে তিনি ১৯৬০ সালে ভারতে যান। এসময় তিনি অবসর জীবনযাপন করছিলেন। যশোরের তৎকালীন জেলা কমিশনার এম.আর. কুদ্দুস সহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা তাকে ভারতে চলে যেতে বলেছিলেন। মার্কিন সরকার তাকে একটি দূরবীন উপহার দিয়েছিলো। এছাড়া তিনিও জমি বিক্রি করে একটি দূরবীন কিনেছিলেন। ভারতে যাবার সময় তিনি দূরবীন নিয়ে যান। কিন্তু বেনাপোল বন্দরে কাস্টম্স তার দূরবীন জবরদস্ত করে। এরপর ভারতে যেয়ে তিনি আমেরিকা ও ফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে, যশোরের ডিসি রাধাগোবিন্দের বাড়িতে গিয়ে তার দূরবীন ফেরত দেন।ভারতে যাবার পর সেখানে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে পুস্তক রচনা করেন। তাঁর জীবদ্দশায় একমাত্র ধূমকেতু বইটি প্রকাশিত হয়।
শেষ বয়সে তার বেশ আর্থিক অনটন দেখা দিয়েছিলো। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ একসময় আকাশে রাজত্ব করলেও, তিনি কলকাতার মাটিতে ভিখারির মত শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। আমরা তাঁকে না চিনলেও বিশ্ব তাঁকে রাজা হিসেবেই চেনে। আর তিনি পৃথিবীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের রাজা হয়েই বেঁচে থাকবেন সবসময়।পৃথিবীর খ্যাতনামা এই মহান জ্যোতির্বিদ, ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল, ৯৭ বছর বয়সে একরকম বিনা চিকিৎসায় কলকাতার বারাসাতে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: