“হিন্দুরা এখন আর জাতপাত মানে না” বিশ্বাস করি বলুন তো?

Uncategorized

অনেক দিন থেকে অনেকজন আমাকে হিন্দুদের জাতপাত ও কথিত মহাপুরুষদের বিরুদ্ধে লিখতে বলছেন। আগেও এটা নিয়ে লিখেছি তাদের হয়ত চোখে পড়েনি। যারা অনুরোধ করছেন তারা সবাই হিন্দু পরিবারের মানুষ। বলছেন মুসলমানদের যেমন জিহাদ হিন্দুর তেমন জাতপাত। আমরা হিন্দুরা তিলে তিলে মরছি যদি এটা নিয়ে একটু লিখেন…

হিন্দু কাপুরুষ যুব সমাজের কাছে এখন জনপ্রিয় টপিক হচ্ছে ‘লাভ জিহাদ’! হিন্দু মেয়েদের মুসলমান যুবকরা প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে ধর্ম পরিবর্তন করে ফেলছে! এতে তারা মনোক্ষুণ্ন। আরে স্কাউন্ডেল হিন্দু ঘরের মেয়েগুলি আসলে হিন্দু ধর্মের জেলখানা থেকে মুক্তি পেতেই ধর্মান্তরিত হচ্ছে! ওরা জন্মদুঃখী! হিন্দু জেলখানা থেকে রেহাই পেতে গিয়ে রোরখা পর্দার ইসলামী জেলখানায় গিয়ে ঢুকে! একটা হিন্দু মেয়ের পছন্দ করে বিয়ে করার অধিকার এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নেই! তার স্বামী সে-ই হবে যে স্বজাতের স্বগোত্রের! এই নিয়তির লিখন কিছুতে লঙ্ঘন হবার নয়! লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে কথা না বলে এইসব জাত দেখে বিয়ের বিরুদ্ধে কথার বলো। পারলে হিন্দু ছেলে মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে দেখাও তো! তোমাদের হিন্দু সমাজ সেই মেয়েকে মেনে নিবে?

এইসব বলতে আসলেই কিছু হিন্দু হৈ হৈ করে এসে গলা ফাটাবে- আজকাল হিন্দুরা কোন জাতপাত মানে না। শহরে এসব উঠেই গেছে। আমার নিজের দাদাই তো নমশুদ্র বিয়ে করেছে ইত্যাদি…।

এইসব হিন্দুগুলোর চরিত্র অবিকল মডারেট মুসলমানদের মত। যে করেই হোক ধর্মকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে। হিন্দুদের জীবনে মোটেই জাতপাত উঠে যায়নি। কোলকাতার শহুরে আল্টা মর্ডান চাকুরি করা মেয়েদের জীবনযাপন সামগ্রীক হিন্দু সমাজের চিত্র নয়। বাংলাদেশের হিন্দুদের জীবনে তো জাতপাত একটা বিরাট কিছু। এটুকু না থাকলে হিন্দুর আর কি রইল- এমন একটা ব্যাপার। সারা ভারতের বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিপুলভাবে জাতপাত কঠরভাবে পালিত হচ্ছে। ধর্মে সকলেই হিন্দু তবু কেউ দলিত পতিত আর কেউ জাতিশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে হিন্দুদের ঘিনঘিনে জাতিভেদ বহাল তবিয়তেই আছে। পাজি দেখে শুভদিন ঠিক করে হিন্দুরা। তাদের বিয়েশাদি, ব্যবসাপাতির আয়োজন সব ধর্মীয় কুসংস্কার মেনে। আজো মহা ধুমধামে শনির পুজা, বিপদনাশিনির পুজা চলে। তবু নাকি হিন্দুরা আজকাল ধর্ম মানে না!

হিন্দুদের দুই জনপ্রিয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও অনুকূল চন্দ্র যে কতবড় রেসিস্ট ছিলেন জাতপাত নিয়ে সেটা তাদের নিজের মুখে বলা বাণী শুনলে শিউরে উঠতে হয়। এই দুইজন বাঙালী হিন্দুর কাছে আজো বিপুলভাবে জনপ্রিয় এবং পুজনীয়। তাহলে কি করে হিন্দু সমাজ থেকে জাতপাত যাবে বলুন তো? এদের যারা অনুসরণ করে তারাই তো পরিবারে সমাজে জাতপাতকে মাথায় করে রাখবে।

হিন্দুদের কথিত উদার যত মত তত পথ বাতলে নেয়া রামকৃষ্ণ কত বড় বর্ণবাদী ছিলেন তা সিস্টার নিবেদিতার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় – “তথাপি শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কামারপুকুরের ব্রাহ্মণযুবকরূপে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমন করেন, তখন তিনি এত আচারনিষ্ঠ ছিলেন যে, এক নিম্নশ্রেণীর নারীকর্তৃক মন্দির নির্মাণ এবং ঐ উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দান তাঁহার অত্যন্ত বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল। তিনি ছিলেন প্রধান পুরোহিতের কনিষ্ঠভ্রাতা এবং সেজন্য প্রতিষ্ঠাদিবসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁহাকে পূজানুষ্ঠান কার্যে সহয়তা করিতে হয়। কিন্তু কিছুতেই তিনি প্রসাদ গ্রহনে সম্মত হন নাই। শোনা যায়, সব শেষ হইয়া গেলে, এবং সমাগত লোকজন চলিয়া গেলে গভীর রাতে তিনি বাজার হইতে একমুঠা ছোলাভাজা কিনিয়া আনেন এবং উহা খাইয়া সারাদিন উপবাসের পর ক্ষুধা নিবৃত্ত করেন।” (পৃষ্ঠা ১৭০, স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, ভগিনী নিবেদিতা, উদ্বোধন কার্যালয়)।

এই কথিত নিম্নশ্রেণীর নারীটি হচ্ছেন রানী রাসমনি। শূদ্র হওয়ায় তার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়ির প্রসাদ তিনি মুখে দেননি। রামকৃষ্ণ বালক বয়েসে এক কামার স্ত্রীর হাতে অন্ন খেয়েছিলেন দেখিয়ে তাকে ভক্তরা জাতপাতহীন সাজাতে চাইলে কি হবে, পরিণত বয়সে গদাধর থেকে রামকৃষ্ণ হয়ে তিনি কি বলেছিলেন দেখুন –

“কৈবর্তের অন্ন খেতে পারি না দাদা।আমার এখনকার অবস্থা, – বামুনের দেওয়া ভোগ না হলে খেতে পারি না !” (পৃষ্ঠা ৩২, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম খণ্ড, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সিগনেট প্রেস)।

ছেলেবেলার কামার বাড়ির অন্ন খাওয়া নিয়ে তার মন্তব্য ছিলো ঘৃণায় মিশ্রিত। কামারের গায়ে নিশ্চয় ছোটজাতের বিশ্রী গন্ধ লেগে থাকে -“আমার কামারবাড়ির দাল খেতে ইচ্ছা ছিল; ছেলেবেলা থেকে কামাররা বলত বামুনরা কি রাঁধতে জানে? তাই খেলুম, কিন্তু, কামারে কামারে গন্ধ।” (পৃষ্ঠা ১৩২, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত দ্বিতীয় খণ্ড, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়)।

রাসমনি কথিত ছোটজাত বলে তার কি ঘৃণা ছিলো সেরকম একটি প্রমাণ আছে এই বইতে-

“ঠাকুর কিন্তু ঐ আনন্দোৎসবে সম্পূর্ণহৃদয়ে যোগদান করিলেও আহারের বিষয়ে নিজ নিষ্ঠা রক্ষাপূর্বক সন্ধ্যাগমে নিকটবর্তী বাজার হইতে এক পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনিয়া খাইয়া পদব্রজে ঝামাপুকুরের চতুষ্পাঠীতে আসিয়া সে রাত্রি বিশ্রাম করিয়াছিলেন।” [পৃষ্ঠা ৮৪, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খণ্ড, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়]

শুদ্র রাসমনির মন্দিরের প্রসাদ তিনি  খাবেন না! “ভোজ্য পদার্থ অপরিমিত পরিমাণে প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু পরমহংসদেব তাহা কিছুই স্পর্শ করেন নাই। তিনি সমস্ত দিবস অনাহারে থাকিয়া রাত্রিকালে নিকটস্থ এক মুদির দোকান হইতে এক পয়সার মুৃড়কি ক্রয় করিয়া ভক্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি কি জন্য যে মন্দিরের সামগ্রী স্পর্শ করেন নাই, আমরা তাহার কোনো কারন প্রদর্শন করিতে পারিলাম না।” [পৃষ্ঠা ৫, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনবৃত্তান্ত, রামচন্দ্র দত্ত, উদ্বোধন কার্যালয়]

নিজের বড়দাকে ছোটজাতের ভাত খেতে যে পারেন না সেটা বলছেন রামকৃষ্ণ অকপটে-

“কৈবর্তের অন্ন খেতে পারি না দাদা।” [পৃষ্ঠা ৩২, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম খণ্ড, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সিগনেট প্রেস]

হিন্দু আরেক কাল্ট ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র ছোট জাতে মেয়ে বিয়ে দিলে হিন্দুর কত বড় ক্ষতি হয় তাই ছন্দে ছন্দে বলেছেন, “উচ্চের মেয়ে নিলে ঘরে , দিলে নিম্ন বরে/ বংশ মরে লক্ষী ছারে , রাষ্ট্রে আঘাত পরে”

হিন্দু পুরুষকে এই প্রতারক ধর্মগুরু দুটি বিয়ে করতে বলেছেন। একটি স্বজাতির উচ্চবর্ণের দ্বিতীয়টি নিন্মবর্ণের। শূদ্রের পেটে ব্রাহ্মণ সন্তান পয়দা করে তিনি ছোটজাতকে সুদ্ধি করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনুকূল যে কি পরিমাণ নারী বিদ্বেষী শয়তান ছিলেন সেটা তারই অমৃতবাণী থেকেই পরখ করে নিন। বিভৎস সব চিন্তাভাবনা। একজন মানুষ এসব বিশ্বাস করে মেনে নিলে নিজ পরিবারের নারীদের কি চোখে দেখবে সেটা পড়েই দেখুন-

এক মা জিজ্ঞাসা করলেন, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা সত্ত্বেও
স্বামী যেখানে স্ত্রীর সঙ্গে দূর্ব্যবহার করে, সেখানে স্ত্রীর কী করবে?

শ্রীশ্রীঠাকুর- ঐ কথাই তো বলছিলাম। প্রকৃতিগত সামঞ্জস্য
দেখে বিয়ে না দিলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই জীবন বিধ্বস্ত হ’য়ে যায়।
তুমি তোমার ধারনা অনুযায়ী হয়তো ভাল ব্যবহার করছ, কিন্তু স্বামীর
হয়তো অনুযোগ- আমি যা চাই, আমি যা পছন্দ করি, আমার স্ত্রী কিছুতেই
তেমনভাবে চলে না, সে তার নিজের খেয়ালমত চলে,
আমি তাকে নিয়ে আর পারি না। বড়জোর হয়তো বলবে, আমার
স্ত্রী এমনি ভাল মানুষ, কিন্তু আমি কিসে খুশি হই, আমি কিসে ভাল থাকি,
তা সে বোঝে না। তার নিজের এক ধরণ আছে, সেই ধরনে চলে। আমি বহু
ক্ষেত্রে দেখেছি, স্ত্রীর মত স্ত্রীও খারাপ নয়, স্বামীর মত স্বামীও খারাপ
নয়। উভয়েই ভাল মানুষ বলে সুনাম আছে বাইরে। সবার সঙ্গেই তাদের ব্যবহার
ভাল, কিন্তু উভয়ের মধ্যেই আর কিছুতেই বনিবনা হয় না। বিয়ে থাওয়ার এমনতর
গরমিল যদি কোথাও ঘটে গিয়ে থাকে, সেখানে স্বামী-স্ত্রীর
প্রকৃতিটা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত এবং স্বামীর যাতে ভাল লাগে ও ভাল
হয় নিজের ব্যবহার সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করা উচিত। একটা জ্যান্ত
মানুষের সাথে ব্যবহার করার সব সময় স্মরণ রাখা উচিত, আমি ইট, কাঠ
বা পাথরের সঙ্গে ব্যবহার করছি না। যার সঙ্গে ব্যবহার করছি তার
একটি রুচি আছে, প্রকৃতি আছে , মেজাজ আছে, ধরণ আছে। বদ্যি যেমন
নারী টিপে ধাত বুঝে ওষুধ দেই, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের দাওয়াইও
তেমনি ধাত বুঝে প্রয়োগ করতে হয়। এক কথায় মানুষের মন-মেজাজ
বুঝে চলতে হয়। এমনটি যদি না চলতে পার তবে তোমার ভালর
ধারণা নিয়ে আবদ্ধ হ’য়ে থাকলে তুমি কিন্তু কখনও মানুষের মন পাবে না। শুধু
স্বামীর সঙ্গে ব্যবহারেই এমনতর নয়। প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যবহারেই চোখ, কান, মন
খোলা রেখে চলবে। নজর করবে, কে কখন কী অবস্থায় আছে। তাই বুঝে তখন
যা বলার বলবে, যা’ করার করবে। তুমি হয়তো মনে করে রেখেছ, স্বামীর
কাছে সংসারের একটা প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য আবদার করবে। স্বামীর মন
কেমন তা লক্ষ্য না করে, তুমি তোমার চিন্তার সম্ভেগ অনুযায়ী এমন সময়ই
হয়তো কথাটা তাকে বললে যখন তার মন নানা সমস্যায় ভারাক্রান্ত। তখন
সে তো চটবেই। আবার, তুমিও বলবে, আমি তো নিজের জন্য কিছু
চাইতে যাইনি, সংসারের জন্য দরকার, সেই দরকারী জিনিসের
কথা বলতে গিয়ে কত কথা শুনলাম। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।
আমার ভাল কথাটাও তোমার গায়ে সয় না। এই বেধে গেল আর
কি লাঠালাঠি। পরস্পর হিসাব করে না চলার দরুন অনেক গোলমালের সুত্রপাত
হয়। মেয়েদের বিশেষ বিশেষ শারীরিক অবস্থায় বিশেষ-বিশেষ মেজাজের
সৃষ্টি হয়, সেটা হলো সাময়িক ব্যাপার এবং শারীরিক অবস্থার সাথে জড়িত।
পুরুষ ছেলের এটা সম্পর্কে যদি কোন জ্ঞান না থাকে এবং তখনকার
স্বাভাবিক বৈলক্ষণ্যের দরুন যদি অযথা শাসন করতে যায়, তাহলে কিন্তু
হিতে বিপরীত ঘটে। আবার, স্বামী হয়তো ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে, কিন্তু
স্ত্রী হয়তো অগোছাল, অপরিচ্ছন্ন রকমে চলতে অভ্যস্ত। সেখানে স্ত্রীর ঐ
চলনে স্বামীর তো অসন্তুষ্ট হবার কথাই।
মা-টি অকপটে বললেন, আমার ঐ দোষটি আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর: দোষ যদি বুঝে থাকিস, তবে সেরে ফ্যাল্। যা করলে শরীর-
মনের পক্ষে ভাল হয়, ছেলেপেলে ভাল থাকে, স্বামীরও মনোরঞ্জন হয়,
তা তো করাই লাগে। স্বামীর কাছে যত সময় নত থাকবি। যুক্তি তর্ক
দিয়ে কারো মন জয় করা যায় না। তোর যদি কখনও মনেও হয় যে, স্বামী তোর
সঙ্গে অকারণ দূর্ব্যবহার করছে, তাও বলবি, আমি কথাটা বলতে চেয়েছিলাম
ভাল, কিন্তু ভাল করে বুঝিয়ে বলতে না পারায় তোমার অশান্তির কারণ
হয়েছি। ত্র“টি আমারই। এইরকম যদি করতে পারিস তাহলে দেখতে পাবি,
স্বামীর সব রাগ গলে জল হয়ে যাবে। একটা জায়গায় কেবল স্বামীর
বিরুদ্ধে দাড়াতে পারিস, অর্থাৎ যদি দেখিস, স্বামী তাঁর মা-
বাবা বা গুরুজনের সঙ্গে অসমীচিন ব্যবহার করছে, সেখানে কখনও কিন্তু
স্বামীর পক্ষ সমর্থন করতে যাবি না, শ্বশুর-শাশুড়ীর পক্ষ হয়ে সেখানে ন্যায্য
প্রতিবাদ করবি। স্বামীর মঙ্গলের জন্যই এটা করা দরকার। অনেক স্ত্রী তাদের
স্বামীকে তাদের গুরুজন ও আপনজন হতে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের
আঁচলধরা করে রাখতে চায়। ভাবে, আমরা স্বামী-স্ত্রী ছেলেপেলেদের
নিয়ে সুখে থাকতে পারলে হলো, আর চাই কী? কিন্তু এত যে স্বামীর প্রতি ও
নিজের প্রতি শত্র“তা করা হয়, এ-কথাটা বোঝে না। স্বামীর
প্রতি শত্র“তা এদিক দিয়ে যে, স্বামী যাদের নিয়ে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ,
প্রীতি, দায়িত্ব ও কর্ত্তব্যহীন করে তুললে সে ধীরে ধীরে অমানুষ হয়ে পড়ে,
তার জগৎটা হয়ে যায় সংকীর্ণ; কারণ, যে নিজের মা, বাপ,
ভাইবোনকে ভালবাসতে পারে না, তাদের প্রতি কর্ত্তব্য করতে পারে না,
সে দেশ ও দশকে ভালবাসবে, তাদের জন্য করবে, এ একটা মিছে কথা। অমনতর
যারা, তারা বড়জোর তথাকথিত politics (রাজনীতি)করতে পারে নাম-
চেতানর জন্য, স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য। অন্তরের আসল বিস্তার তাদের কিছুই হয় না।
আর, তাদের আত্মপ্রসাদ বলেও কিছু থাকে না। যাদের খুশি করে, যাদের
আশির্বাদ ও প্রসাদ লাভ করে মানুষ বড় হবার প্রেরণা পায়, তাদের প্রতি টানই
যদি ছিঁড়ে যায়, তবে তার সম্বল কি রইল জীবনে তা তো বুঝি না।
ওভাবে রিক্ত ও নিঃসম্বল হয়ে করে দিল যে তাকে মনোজগতে, তার
প্রতি একদিন তার আক্রোশ আসাও অসম্ভব না। তখন ঐ
স্ত্রীকে হয়তো সে দুচক্ষে দেখতে পারে না। ভাবে, ঐ ডাইনী আমার
সর্বনাশ করেছে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সকলের
থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে আমাকে। আমার সাজানো বাগান
শুকিয়ে ফেলেছে। ও আমাকেও চায় না। ও চায় আমাকে দিয়ে ওর নিজের
খেয়াল পূরণ করতে। এটা প্রকারান্তে নিজের প্রতি শত্র“তা নয় কি? তাছাড়া,
যে ছেলেপেলেদের সুখসুবিধার দিকে চেয়ে অমন করে, তাদেরও কি ভাল
হয়? যে সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতার দীক্ষা তাদের দেয়, তার ফলে তারাও
তো পরস্পরকে ভালবাসতে শেখে না। কালে-কালে তারাও তো মা-
বাবা ও ভাই-বোন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেমনতর বীজ বোনা যায়,
তেমনতর ফলই তো ফলবে। তখন হয়তো দেখবে, তোমার একটি ছেলে চর্ব্য, চোষ্য,
লেহ্য, পেয় খাচ্ছে আর একটি ছেলে পথে-পথে না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,
কিন্তু সে তাকে এক মুটি ভাতও দিচ্ছে না। দিতে চাইলেও তার স্ত্রীর
ভয়ে পারছে না। এই অবস্থা দেখলে তোমার কি ভাল লাগে? কিন্তু এই
অবস্থাটার তো সৃষ্টি করলে তো তুমি।
মা-টি সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, ঠাকুর! আপনি আর বলবেন না, শুনে বড় ভয় করে।
মেয়ে মানুষ বোকা জাত, তাদেরই কি যত দোষ? মেয়েমানুষ ভূল
করে যদি স্বামীকে তার বাপ-মার থেকে নিজের দিকে টানতে চায়,
তাহলেই স্বামীও কি সেই ভূলে সায় দেবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর তা তো দেওয়া উচিতই নয়। পুরুষেরই তো দায়িত্ব বেশী। সেই
তো তার পিতৃভক্তি ও মাতৃভক্তির দৃষ্টান্তে স্ত্রীকে তাদের
প্রতি আরো শ্রদ্ধাপরায়ণ করে তুলবে। যেখানে স্বামীর অতখানি দৃঢ়তা ও
পৌরুষ নেই, সেখানে সতী স্ত্রীর অনেকখানি করণীয় আছে। সে যদি স্বামীর
ভালই চায়, তবে তাই করবে যাতে স্বামীর মঙ্গল হয়। স্বামী যদি তার মা-
বাবার প্রতি কর্ত্তব্যচ্যুত হতে চায়, সে বরং তখন
কলেকৌশলে চেষ্টা করবে যাতে বাপ-মার প্রতি তার টান
বাড়ে এবং আবেগভরে সে তাদের সেবাযতœ করে। মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধা,
ভক্তি, প্রীতি ইত্যাদি বাড়াবার জন্য অনেক সময় দূতীগিরি করতে হয়।
স্ত্রী হয়তো স্বামীকে বলল, বাবা-মা তোমাকে খুব ভালবাসেন। বলেন ও
রাগধাগ করলে কি হয়? মন ওর খুব ভাল। বাইরে আধিক্যেতা নেই। কিন্তু সকলের
প্রতি অনেক টান। আবার, শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে হয়তো বলতে হয়,
উনি আমাকে সবসময় বলেন, আমার কিছু করা লাগবে না তোমার। তুমি সব সময়
দেখবা, বাবা-মার যাতে কোন কষ্ট না হয়।
এইভাবে যদি কৌশলে দূতীগিরি করা যায়, তাহলে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা,
প্রীতি, ভাব-সাব গজিয়ে দেওয়া যায়। এই তো সতী স্ত্রীর কাজ,
লক্ষ্মী বৌয়ের কাজ। গড়া সংসার ভাঙবে না সে, ভাঙা সংসার গড়বে সে,
জোড়া লাগাবে সে। মায়েদের তুই বোকা বলিস? বোকা হলে কখনও সন্তান
পেটে ধরে মানুষ করে তুলতে পারে? দে তো একটা ব্যাটাছাওয়ালের
কাছে একটা মা হারা শিশুকে মানুষ করার ভার। প্রায়ই হাগে-
মুতে একসা করে ফেলবেনে। কিন্তু মায়েরা কেমন অনায়াসেই করে তা। তাই
নিজেদের কখনও ভাববি না। তোরাইতো বুদ্ধিস্বরুপিণী, লক্ষ্মীস্বরুপিণী,
দূর্গতিনাশিনী, দুর্ম্মতিদলনী দূর্গা। তোরা আছিস, তাই তো আমাদের
আগলে রেখেছিস। নইলে আমাদের উপায় ছিল কী?
(সূত্র: আলোচনা প্রসঙ্গে, ৬ই কার্তিক, শুক্রবার, ১৩৪৯ (ইং ২৩/১০/১৯৪২)।

এইসব ঠাকুর দেবতায় যখন শিক্ষিত হিন্দুরা ভুক্তিতে শুয়ে পড়ে প্রণাম জানায় তখন কেমন করে “হিন্দুরা এখন আর জাতপাত মানে না” বিশ্বাস করি বলুন তো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *