হিন্দু দানপত্র আইন

Uncategorized
হিন্দু দানপত্র আইন
ভারত, নেপাল যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সকল দেশের বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিশেষ সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দিনেদিনে অবনতি হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তাদের পুরাণত শাস্ত্রীয় আইনকে পরিবর্তন করতে আপাতত রাজি নয়। তবে বিভিন্ন অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিওর সাথে যুক্ত নেতৃবৃন্দ ব্যতিক্রম। তাই আপাতত হিন্দু বিশেষ আইনে পরিবর্তন না করে, বিদ্যমান আইনের মধ্যেও বহু বিষয়ের অত্যন্ত যৌক্তিক সমাধান করা যায়। একটি দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যায়।হিন্দু অনেক পিতামাতার যদি কোন পুত্র সন্তান না থাকে এবং শুধুই এক বা একাধিক কন্যা সন্তান থাকে তারা তাদের সম্পত্তির উত্তরসূরী নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তারা মাত্র ১০০ টাকা সরকারি রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা সন্তানসন্ততিদের নামে দান করতে পারেন।এ আইনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে অনেক আগে থেকেই আছে। তাদের কাছে এ আইনটি ‘হেবা’ নামে পরিচিত। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ২০০৯ সালে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এই আইনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী আইনটি বাস্তবায়নের কথা দিয়ে বলেন, হেবা আইনের সাথে যেহেতু ইসলামের বিধান জড়িত আছে। ঠিক সেভাবেই দানপত্রের কোন বৈদিক বা বেদানুগত বিধান প্রদান করতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে তৎকালীন আইনমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় আইনটি ড্রাফট করা শুরু হয়। পরবর্তীতে আইনটি পাশ হয়।আইনটি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের জন্য প্রযোজ্য হয়। একজন অবিভাবক নির্ঝঞ্ঝাটভাবে দানপত্রের মাধ্যমে তাদের সন্তানসন্ততিদের মাঝে সম্পত্তি দান করতে পারেন। এ দানপত্রে খরচ মাত্র ১০০ টাকা। আইনটি আজ ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এসেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে অত্যন্ত পরিচিত। এমনকি অনেক আইনজীবীরাও দেখেছি এ আইনের বিষয়টি জানেন না। তাই আমি সরকারি গেজেট থেকে সম্পূর্ণ আইনটি তুলে দিচ্ছি:
Published in Bangladesh Gazette Extra-ordinary Dated 24th September, 2012
Act No. 41 of 2012
Registration Act, 1908 এর অধিকতর সংশোধকল্পে প্রণীত আইন
যেহেতু নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্যসমূহ পূরণকল্পে Registration Act, 1908 Act No. XVI of 1908) এর অধিকতর সংশোধন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্‌দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল :
১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন।–(১) এই আইন Registration (Amendment) Act, 2012 নামে অভিহিত হইবে ।
(২) সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করিবে সেই তারিখে এই আইন কার্যকর হইবে।
21 Act No. XVI of 1908 এর section 17 এর sub-section (1) এ নূতন clause (aaa) এর সন্নিবেশ।
Registration Act, 1908 (Act No. XVI of 1908), অতঃপর উক্ত Act বলিয়া উল্লিখিত, এর section 17 এর sub section (1) এর clause (ca) এর পর নিম্নরূপ নূতন clause (aaa) সন্নিবেশিত হইবে, যথাঃ—
“(aaa) declaration of gift under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law,”
31 Act No. XVI of 1908 এর section 78A এ নূতন clause (bb) এর সন্নিবেশ।– উক্ত Act এর section 78A এর clause (b) এর পর নিম্নরূণ clause (bb) সন্নিবেশিত হইবে,
“(bb) registration fee payable for registration of a declaration of gift of any immovable property made under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law, if such gift is permitted by their Personal Law, shall be one hundred taka irrespective of the value of the property, provided such gift is made between spouses, parents and children, grand parents and grand children, full brothers, full sisters and, full brothers and full sisters;” 
আমি আইনের ছাত্র নই। এরপরও আইনটি পড়ে আমি যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি, তা হল: দেশের
হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশেষ আইন অনুসারে যে কোনও স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মাত্র একশত টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে দান করতে পারবে। স্বামী-স্ত্রী, পিতামাতা এবং সন্তানের মধ্যে; দাদু, পিতামাতা এবং সন্তানদের মধ্যে; সকল ভাইদের মধ্যে, সকল বোনেদের মধ্যে সম্পত্তির মূল্য নির্বিশেষে একশত টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে এ দানপত্র করতে পারবে। তবে এ দানপত্র আইনটি তৈরির সাথে আমার একটি সুখকর স্মৃতি করেছে। সে স্মৃতিটি হল- যখন দানপত্রের কোন বৈদিক বা বেদানুগত পূর্ববর্তী বিধান প্রদান করতে বলেন। তখন সচিবালয়ে এই আইনটি ড্রাফট করা ব্যক্তিগণ, এই আইনের কোন বৈদিক বা শাস্ত্রীয় রেফারেন্স খোঁজা শুরু করেন। সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ঢাকেশ্বরী কেন্দ্রিক হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন। তবে কেউ মৃত্যুর পূর্বে পিতার সন্তানকে প্রদানের রেফারেন্স খুঁজে দিতে পারে না। অথবা এটাও হতে পারে সেই নেতৃবৃন্দের দেয়া রেফারেন্স সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের পছন্দ হয়নি। বিষয়টি বিভিন্ন ব্যক্তি হয়ে আমার কাছে আছে। এ প্রসঙ্গে দুজন কর্মকর্তা আমার সাথে যোগাযোগ করে। তখন আমি ঋগ্বেদ থেকে এমনি একটি পিতার দানপত্রের শাস্ত্রীয় রেফারেন্স খুঁজে দেই। এবং সাথে মন্ত্রটি অনুবাদ করে সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের প্রদান করি। পরবর্তীতে আইনটি পাশ হয়। তারা আমাকে না জানালেও, আমি দানপত্র আইনটি সংসদে পাশ হওয়ার বিষয়টি জানতে পারি। আমার আনন্দ হয় এ বিষয়টি ভেবে যে, সম্প্রদায়ের কল্যাণে পাশ হওয়া একটি আইনের পেছনে, আমার বিন্দু পরিমাণ ভূমিকা রয়েছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন,  চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে একটি ধর্মীয় সংগঠনের অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রিত করে। আমার পূর্ববর্তী বক্তা, ছিলেন চট্টগ্রামের একজন পরম শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সেই অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তৃতায় বলেন যে, হিন্দুদের হেবা বা দানপত্র আইনটি অতিদ্রুতই পাশ হবে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে আস্বস্ত করেছেন যে আইনটি অতিশীঘ্রই সংসদে পাশ হবে। চট্টগ্রামের সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্যের ঠিক পরেই, আমার বক্তব্যের সুযোগ আসলো। আমি তখন আমার বক্তব্যে বললাম- দাদা! আমার খুব দুঃখ লাগলো, এ কথাটি শুনে যে আপনার কথামত আইনটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাশ করে দিবেন। হিন্দু দানপত্র আইনটা অলরেডি কয়েকবছর আগে ২০১২ সালেই পাশ হয়ে গেছে। সেটা তিনি জানেন না। অথচ তিনি ২০১৮ সালে এসে প্রকাশ্য সবায় বললেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলে আইনটি শীঘ্রই পাশ করিয়ে দিতে সাহায্য করবেন। আমি সেই দাদার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, পুনরায় বললাম, দাদা! এতবছর আগে পাশ হয়ে যাওয়া আইনটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অন্ততপক্ষে আপনার জানা উচিত ছিল। দাদার দুর্ভাগ্য ছিল যে, যে ব্যক্তি আইনটি পাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে তথ্যসংগ্রহে বিন্দু পরিমাণ ভূমিকা ছিল; এমনি একজন সেই সভাতেই উপস্থিত। সেখানেই বিপত্তি বা গোল বেঁধেছে। হয়ত এ বক্তব্য দাদা আরও শতশত সভায় দিয়েছেন। সকলেই শ্রোতা হয়ে তার কথা শুধুই শুনে গিয়েছে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *