১৯০৬ ও ১৯১১ সালে তৎকালীন ঢাকায় জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা

Uncategorized
ছবিঃ ১৯০৬ ও ১৯১১ সালে তৎকালীন ঢাকায় জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা।
ইতিহাসের বইপত্রগুলো সাক্ষ্য দেয়, ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো সামাজিক উৎসবগুলোর একটি হলো ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির এই জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা। একসময় ঢাকা শহরে জন্মাষ্টমীর যে শোভাযাত্রা বের হতো তা সারা উপমহাদেশে ছিল বিখ্যাত। কালের স্রোতে এ তিথিতে পূজোর সাথে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় র‌্যালি বা শোভাযাত্রা। ক্রমেই জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এ শোভাযাত্রা। একসময় এ জন্মাষ্টমী উৎসব অথবা জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন ঢাকাবাসী। বর্তমানে এর ছোঁয়া থাকলেও আগের সেই জৌলুস আর নেই। কৃষ্ণের জন্মোৎসবের এই মিছিল ঢাকায় শুরু হয়েছিল ।
শোভাযাত্রার পুরনো ইতিহাস লেখক ভুবন মোহন বসাক এবং যদুনাথ বসাকের দুটি বইয়ের তথ্যানুসারে জন্মাষ্টমী উৎসবে শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকে। ভুবন মোহনের লেখা বই অনুসারে ইসলাম খাঁর ঢাকা নগরের পত্তনের (১৬১০ সাল) আগে বংশালের কাছে বাস করতেন এক সাধু। ১৫৫৫ সালে (ভাদ্র ৯৬২ বাংলা) তিনি শ্রীশ্রী রাধাষ্টমী উপলক্ষে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি র‌্যালি বের করেছিলেন। এর প্রায় ১০-১২ বছর পর সেই সাধু ও বালকদের উৎসাহে রাধাষ্টমীর কীর্তনের পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণের জন্মোপলক্ষে জন্মাষ্টমীর অপেক্ষাকৃত জাঁকজমকপূর্ণ একটি শোভাযাত্রা বের করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সে উদ্যোগেই ১৫৬৫ সালে বের হয় প্রথম জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা। পরবর্তীকালে এ মিছিলের দায়ভার এসে বর্তায় ঢাকার নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর। কালক্রমে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা একটি সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে এবং প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উৎসবের নিয়মিত অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ১০৪৫ বঙ্গাব্দে কৃষ্ণদাসের মৃত্যুর পর থেকে শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রই এ উৎসবের আয়োজন শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রাকে উন্নত করে তোলেন। এরপর থেকে নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে বের করতে শুরু করে নিজ নিজ শোভাযাত্রা। কালক্রমে যা পরিচিত হয় ওঠে ‘নবাবপুরের মিছিল’ নামে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইসলামপুরের পান্নিটোলার কিছু ব্যবসায়ী ধনাঢ্য হয়ে ওঠে এবং কৃষ্ণের অনুসরণে তারা বের করতে শুরু করেন জন্মাষ্টমীর র‌্যালি। ১৭২৫ সালে জেমস টেলর উল্লেখ করেন, ওই সময় জন্মাষ্টমী পালনের জন্য দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। নবাবপুর পক্ষকে বলা হতো, লক্ষ্মীনারায়ণের দল আর ইসলামপুর পক্ষকে বলা হতো, মুরারি মোহনের দল।
সপ্তদশ শতকে শোভাযাত্রার শুরু হলেও তা বিকশিত হয়েছিল মূলত উনিশ শতকের শেষার্ধে, যে ধারা বলবৎ ছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। প্রথম দিকে র‌্যালিতে নন্দঘোষ, রানী যশোদা, শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে আনা হতো। ক্রমেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে আরো নানা ধরনের অনুষঙ্গ। তবে মূল কাঠামোটি ছিল প্রথমে নেচে-গেয়ে যাবে কিছু লোক, এরপর দেব-দেবীর মূর্তি, লাঠিসোঁটা, বর্শা, নিশান প্রভৃতি নিয়ে বিচিত্র পোশাক পরিহিত মানুষ, নানা রকমের দৃশ্য। শোভাযাত্রার প্রধান আকর্ষণগুলো ছিল সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, রঙিন কাগজে মোড়ানো বাঁশের টাট্টি, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির, মঠ, প্রাসাদ ও প্রাচীন কীর্তির প্রদর্শন। সেসব আয়োজন এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতার পরও ঢাকায় এখনো জন্মাষ্টমী উৎসব ও শোভাযাত্রা
মুনতাসীর মামুন ইতিহাসবিদ ভুবনমোহন বসাককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ১৯৫৫ সালে বংশালের সাধুই প্রথমে শ্রীশ্রীরাধাষ্টমী মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। সেই সাধুর উৎসাহেই পরে কৃষ্ণের জন্মতিথিতে মিছিল করার অনুমতি মেলে। ১৫৬৫ সালে জন্মাষ্টমীর নন্দোৎসবের সময় প্রথমবার জাঁকজমকের সঙ্গে মিছিল হয়। ঢাকার মুসলমানেরা এই মিছিলকে বলত ‘বার গোপালের মিছিল’।
চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর আত্মজীবনী জিন্দাবাহার-এ বলেছেন, আক্ষরিকভাবে জন্মাষ্টমীর মিছিল ছিল সর্বজনীন। চল্লিশের দশকে তাঁর দেখা জন্মাষ্টমী মিছিল নিয়ে মোহনও বললেন, সে সময় এখনকার চাইতে মিছিলে অনেক বেশি লোক হতো। মিছিলে যোগ দেওয়া আর পথের ধারে দাঁড়িয়ে দেখাদের দলের প্রায় অর্ধেকই ছিল মুসলমান। গোলমরিচের ঝাল নাড়ু আর নারকেলের মিষ্টি নাড়ুর লোভে তাঁর মুসলমান বন্ধুরা ভিড় করতেন মিছিলে। স্মৃতি হাতড়ে আরও বললেন, তাঁর ছেলেবেলায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন হরিজন নারী-পুরুষেরা। বড় নথ আর আলাদা ঢঙে শাড়ি পরা হরিজন নারীদের দেখলেই চেনা যেত। তাঁর কথায়, ‘ওই এক দিনই ওরা হিন্দু ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দাঁড়াতে পারত। ব্রজবুলী ভাষায় কীর্তন গাইত ওরা।’
গতকালের মিছিলে হরিজনদের আলাদা করে চোখে পড়েনি; যেমন মাইকের উঁচু গ্রামের শব্দে হারিয়ে গেছে কীর্তনের দলের ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ ধ্বনি। ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহনের লেখায় পাওয়া যায়, ১৭ শতকের মিছিলের সঙ্গে ভক্ত-বৈষ্ণবেরা খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গাইতে গাইতে চলতেন। ওই কীর্তন ছিল জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রাণ।
বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথও বললেন কিছু হারিয়ে যাওয়া রীতির কথা। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর ঢাকায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। একাত্তরে স্বাধীনতার পর ছোট পরিসরে শুরু হয়। শেষমেশ ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে আবার ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল চালু হয়।
Pic- নিখিল দেবশর্মণ
Source- অঞ্জন আচার্যের আর্টিকেল ও মুনতাসীর মামুনের সাক্ষাৎকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *