এক. ২৫শে ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন নয়। বাইবেলে এরকম কোনো তথ্য নেই।
দুই. খ্রিষ্টমাস মূলত রোমান স্যাটার্নালিয়া উৎসবের খ্রিষ্টীয় রূপ।
স্যাটার্ন বা শনি ছিল রোমান প্যাগানদের কৃষি দেবতা। এই দিনে রোমান স্যাটার্ন টেম্পলে বিরাট জাকজমকপূর্ণ পূজা ও উৎসব পালন করা হতো। তবে এ উৎসব শুধু মন্দিরেই হতো না। স্যাটার্নালিয়াকে তুলনা করা যায় কিছুটা ঈদ ও দুর্গাপূজার সঙ্গে, তবে আরো বেশি মানবিক।
ঈদের সঙ্গে এই অর্থে যে প্রতি ঘরেই এ উৎসব পালিত হতো এবং দুর্গাপূজার সঙ্গে এই অর্থে যে স্যাটার্নালিয়া ছিল সপ্তাহব্যাপি উৎসব। এ সময়ে একে অপরকে ছোটো ছোটো উপহার দেয়া হতো, যেমন মোম, পুতুল, পাখি, ইত্যাদি। আর মানবিক এই অর্থে যে এসময়ে দরিদ্র ও দাসদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হতো। এমনও হতো যে দাসদের এক দিনের জন্য গৃহসদস্য বা মাস্টার হিসেবে ট্রিট করা হতো, অর্থাৎ তাদেরকে মাস্টারের পোশাক পরানো হতো (গৃহকর্তা পরতেন দাসের পোশাক) এবং গৃহকর্তী খাবার বানিয়ে দাসদের সামনে পরিবেশন করতেন। এছাড়াও পাইন গাছের ডাল কেটে এনে সাজানো হতো, ঠিক যেভাবে এখন খ্রিস্টমাসে করা হয়।
তবে স্যাটার্নালিয়া কৃষি উৎসব হলেও এর সাথে সংযোগ রয়েছে পৃথিবীর বার্ষিক গতির। যদিও রোমানরা অবগত ছিল না যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলেই ঋতুর পরিবর্তন হয়, তবে এর বহু আগে থেকেই মানুষ সূর্যের অবস্থান ও দৈনিক সূর্যালোকের স্থায়িত্ব অবলোকন করে জেনেছিল কখন পৃথিবীতে দিন-রাত্রি সমান হয় ও কখন সবচেয়ে বড় রাত বা দিন হয়। স্যাটার্নালিয়া ছিল মিড-উইন্টার তথা উইন্টার সলিস্টিস উৎসব, অর্থাৎ এর পরে সূর্যের দৈনিক স্থায়িত্ব ক্রমশ বাড়বে। আর যেহেতু প্রাচীন সকল উৎসবই কৃষিকে কেন্দ্র করে হতো, তাই এই শুভ ক্ষণটাকে তারা কৃষি দেবতা শনিকে কেন্দ্র করে উদযাপন করত। স্যাটার্নালিয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ২১২ পর্যন্ত। ১২ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালিগুলা এটাকে পাঁচ দিনের উৎসব হিসেবে ঘোষণা দেন।
৩১২ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি চার্চের পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেন। কিন্তু সম্রাট খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও রাতারাতি প্যাগান ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি প্যাগানরা তখনও রোমান স্যাটার্নালিয়া উৎসব পালন করত। ইতিহাসে ৪৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্যাটার্নালিয়া উৎসব পালনের রেফারেন্স পাওয়া যায়।
তবে প্রথমদিকে স্যাটার্নালিয়া উৎসব কিন্তু ২৫শে ডিসেম্বরে পালিত হতো না, হতো ১৭ ডিসেম্বর এবং পরবর্তীতে ২১শে ডিসেম্বর। ২৫শে ডিসেম্বরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সিরিয়ান কাল্ট Sol Invictia. এই কাল্টটি ২৫শে ডিসেম্বরকে সূর্যের জন্মোৎসব হিসেবে পালন করত। রোমানরা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের পূর্বে ২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট অরেলিয়ান (Aurelian) Sol Invictia-কে রোমান সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ২৫শে ডিসেম্বরকে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। তখন থেকে স্যাটার্নালিয়ার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় ২৫শে ডিসেম্বর।
রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন পরবর্তীতে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর বেড়ে ওঠা একজন Sol Invictia রূপে। তিনিই ২৫শে ডিসেম্বরকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে পালন করতে শুরু করেন। ২৫শে মার্চকে মেরির গর্ভদিবস হিসেবে বিবেচনা করে এর পরে নয় মাস যোগ করে এই তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে অনেক খ্রিষ্টানই এর সঙ্গে একমত ছিল না। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে, অর্থাৎ বাইজেন্টাইনে যিশুর জন্মদিন পালন করা হতো ৬ই জানুয়ারি।
যাই হোক, ইতিহাস এমন কিছু নয়। মানুষের আনন্দ প্রয়োজন, উৎসব প্রয়োজন, তার উদ্ভব কী করে হলো, সেটা ব্যাপার না। সুতরাং মেরি খ্রিষ্টমাস!