৫০ বছর আগে আজকের দিনে, ৪ ডিসেম্বর ভারতবর্ষ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ র ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল বলে যে ১৬ ডিসেম্বর দিনটাকে ভারতীয় সেনা বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকে, তার সূচনা হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। হিংস্র পাঠান,পাঞ্জাবী,বেলুচ সেনাকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্যে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষকে রক্ষা করার জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৫০ বছর আগে আজকের তারিখে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে প্রায় #৩০ লক্ষ মানুষকে (২৪ লাখই হিন্দু) খুন করেছিলো টিক্কা খানের পাক সেনা। ৫ লাখের বেশী (কারো কারো মতে ৬ লাখ) নারী ধর্ষিতা, গণধর্ষিতা হয়েছিল ইয়াহিয়া খানের ওই পিশাচ সেনাবাহিনীর হাতে। কোথায় গিয়ে এটা থামতো কে জানে! এটা থামাবার জন্যে, সম্পূর্ণ মানবিক কারণে ভারত সেনা অভিযান করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে। ৫০ বছর আগে আজকের দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজের দেশের সীমানা অতিক্রম করতে শুরু করেছিল। সেই দিনের কথা আলোচনা করতে এবং ভারতীয় সেনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে, #হিন্দু_সংহতি-র উত্তরবঙ্গ জোনের পক্ষ থেকে আমরা পৌঁছেছিলাম , 11, মাহার রেজিমেন্টের ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের রিটায়ার্ড ল্যান্সনায়েক ৯৩ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ দাসের বাড়ীতে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর বিধানসভার অন্তর্গত ৬ নং গঙ্গারামপুর অঞ্চলের নারোই এলাকায়। ফুলের তোড়া আর মিষ্টি নিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্সনায়েক রবীন্দ্রনাথ বাবুকে সম্মান জানাবার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি হিন্দু সংহতির শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের বার্তা দেবার জন্যে। মাহার রেজিমেন্ট, নামটার সাথে আগে পরিচিত ছিলাম না। ওনার মেডেলে মাহার রেজিমেন্ট কথাটা খোদাই করা দেখে জিজ্ঞেস করে ওনার মুখে শুনলাম যে এটা মিক্সড বা মিশ্র রেজিমেন্ট। বিভিন্ন রাজ্যের সেনা ভালো সংখ্যাতেই এই রেজিমেন্টে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরীর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার কিছুদিন পর নাকি এই রেজিমেন্ট তৈরী হয়। রবীন্দ্রনাথ বাবুর ৩৫ বছরের সৈনিক জীবন। জম্মু কাশ্মীরের ছাতুয়াড়ি, কালীধর পাহাড়, সাম জুড়িয়া, সাম সিটি এবং আরো কিছু এলাকায় কর্মজীবন কাটিয়েছেন। লাদাখ সীমান্তে, আখনুর সেক্টরে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১, তিন যুদ্ধেই কোন না কোনভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। ১৯৬২ এর ভারত চীন যুদ্ধে লাদাখ সীমান্তে আগুয়ান ভারতীয় সেনার সাপ্লাই লাইন নিরবচ্ছিন্ন রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। এরপর ১৯৬৫ র ভারত পাক যুদ্ধে, ভারতীয় সেনার যে বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীকে গুড়িয়ে দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি(মোহর মসজিদ পর্যন্ত) পৌঁছে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ বাবু ছিলেন সেই বাহিনীর মধ্যে। ১৯৭১ এ যুদ্ধ শুরু হবার আগে তিনি ছুটিতে বালুরঘাটের বাড়ীতে(তখন বালুরঘাটে থাকতেন) এসেছিলেন। তার পরিচয় জানতে পেরে, যুদ্ধ শুরু হবার পর তার কাছে একজন সেনা অফিসার বার্তা পাঠান ওই ছুটির সময়ে সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্ৰহণ করতে। সানন্দে ওই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বাবু। ডাঙ্গি এলাকায় সেনা ঘাটি রক্ষার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
৯৩ বছর বয়সেও তার স্মৃতি একদম তাজা। বয়স তার শরীর বা মনে কোন প্রভাবই ফেলতে পারে নি। তার স্ত্রী সত্তরোর্ধ্ব (যদিও দেখে বয়স অনুমান করা দুঃসাধ্য) অনিমা দাসের স্মৃতিও একদম টাটকা। রবীন্দ্রনাথ বাবু যেখানে যেখানে কর্মরত ছিলেন, সেখানে সেখানে সেনা কোয়ার্টারে থাকতেন। খুব কাছ থেকে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের ধারণা অর্জন করেছেন। ভদ্রমহিলা মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন, কিন্তু যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রাঞ্জল এবং সাবলীলভাবে আলোকপাত করছিলেন।একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বাবুর গোঁফ (বা মোচ) দুদিকের যে কোন দিকে তিন ফুটের বেশী দীর্ঘ। দঃ দিনাজপুরের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে তিনি পরিচিত মোচাড়ু রবীন্দ্রনাথ বলে। আমরা রবীন্দ্রনাথ বাবু এবং অনিমা দেবীকে বললাম যে আপনাদের শ্রদ্ধা জানাবার মাধ্যমে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি হিন্দু সংহতির শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে এসেছি।তারাও অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে দুজনের সাথে আমরা, হিন্দু সংহতির প্রতিনিধি দল বহু বিষয়ে আলোচনা করলাম। আলোচনার প্রভাব এত গভীর ছিল যে ওখানে যাওয়া এবং আসার জন্যে যে টোটোটি রিজার্ভ করে গিয়েছিলাম, সেই টোটো চালক ভদ্রলোক ভাড়া নিতেই চাইছিলেন না। বারবার বলছিলেন যে তার জীবনে এটা একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
✍️✍️✍️✍️ রজত রায় (কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিন্দু সংহতি)